শ্রীমঙ্গল: বার্ড রিংগিংকে সহজ ভাষায় বলা যায় পাখির পায়ে রিং পরানো। তবে ঠিক অংটি নয়।
সম্প্রতি মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওরে ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হলো বার্ড রিংগিং ক্যাম্প। সাত দিনে ৩৩ প্রজাতির ৩৭০টি পাখি ধরে মাপজোখ নিয়ে পায়ে শনাক্তকারী রিং পরিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে পঞ্চাশটির মতো পরিযায়ী পাখির পায়ে রিং পরানো হয়েছে। পাখির আয়তন ও উচ্চতা ভেদে একেকটি রিঙের আকার একেক রকম হয়ে থাকে।
বরেণ্য পাখি গবেষক ও বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ইনাম আল হকের নেতৃত্বে হাকালুকির এই বার্ড রিংগিং কার্যক্রমে অংশ নেন ওমর শাহাদাত, ইসরাত জেবিন, সীমান্ত দীপু, জেনিন আজমেরী, অনু তারেক, ফাতেমা তুজ জোহরা মিলা এবং শাহেদ ফেরদৌস। এছাড়াও ইংল্যান্ডের প্রখ্যাত বার্ড রিংগার স্টিভেন স্যামওয়ার্থ ও বিল জোন্স প্রশিক্ষক হিসেবে উপস্থিত থেকে এ কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
বার্ড রিংগিং বিষয়টি সহজসাধ্য নয় মোটেই। প্রথমে স্থান নির্বাচন করতে হয়। যেখানে বেশি সংখ্যক পাখিদের বিচরণ স্থান হিসেবে বেছে নিতে হয় সেটি। তারপর দিনের যে সময়টাতে পাখি সবচেয়ে বেশি যাতাযাত করে যে সময়টাতে পাতা হয় অতি সূক্ষ্ম এক প্রকারের নেট। অর্থাৎ, জাল। এই জালটি যেখানে-সেখানে পাওয়া যায় না। বন মন্ত্রণালয় শুধু বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবকেই অনুমতি দিয়েছে এই জালটি ব্যবহারে ব্যাপারে।
লম্বালম্বিভাবে সেই জালটি টাঙিয়ে দেয়া হয় পাখিদের বিচরণক্ষেত্রে। জালটি এতোটাই অতি-সুক্ষ্ম যে পাখিদের চোখও এই জালটিকে দেখতে পারে না। পাখির চোখ ফাঁকি দেয়া এই জাল পাতার পর পাখিরা উড়ে যাওয়ার সময় সহজেই আটকে যায়। জাল পাতার কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি একটি করে পাখি সেই জালে আটকা পড়তে থাকে।
পাখি গবেষক দল সঙ্গে সঙ্গে সেই পাখিগুলোকে অতি সতর্কতায় জাল থেকে বের করে এনে শুরু করেন গবেষণার কাজ। তারপর পাখিটির পাখা, পা, নখসহ শরীরের নানা অংশের মাপ নেয়া হয়। পাখির পায়ের পুরুত্ব মেপে নিতে হয় স্লাইড ক্যালিপার্স নামের একটি সূক্ষ্ম মাপনী দিয়ে। মাপ অনুযায়ী বেছে নেয়া হয় নির্দিষ্ট আকারের রিং।
এরপর ছোট প্লায়ার্সের সাহায্যে ওটা পেঁচিয়ে লাগানো হয় পাখির পায়ে।
প্রতিটি রিংয়ে একটি সুনির্দিষ্ট নম্বর থাকে। যেমন: GPO BOX 2624 DHAKA তারপর থাকে রিং নম্বর। ওই নম্বরই বলে দেবে রিং লাগানো প্রতিষ্ঠানের নাম, পাখির ঠোঁট, মাথা, পা ও লেজের পরিমাপ। এমনকি জানা যাবে পাখির একটি ডানায় পালকের সংখ্যাও! প্রতিটি রিং পরাতে সময় ব্যয় হয় পনেরো থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট।
এই রিং পরানোর উদ্দেশ্যই হলো পাখির অবস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহ। রিংয়ের গায়ে যে নম্বরটি সংক্ষিপ্তভাবে যুক্ত থাকে সেই নম্বরটিই প্রমাণ দেয় পাখিটির বিচরণক্ষেত্রের ইতিহাস। যেমন– বাংলাদেশের হাকালুকি হাওরে রিং পরিহিত পাখি যদি সাইবেরিয়ায় গিয়ে ধরা পড়ে অথবা মারা যায় তাহলে তার পায়ের ওই রিংয়ের তথ্য ঘেঁটে পাখিগবেষকরা অবহিত পারবেন যে এ পাখিটি বাংলাদেশে গিয়েছিল।
এছাড়াও হাকালুকি হাওরে রিং পরিহিত কোনো পাখি যদি সেন্টমার্টিনের প্রবালদ্বীপে গিয়ে ধরা পড়ে তাহলেও পাখিগবেষকরা এ পাখিটি অভ্যন্তরীণ বিচরণদীর্ঘতার এ পরিচয় পেয়ে যাবেন।
বন্যপ্রাণি গবেষক, বার্ড রিংগার ও বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের ট্রেজারার ওমর শাহাদাত বাংলানিউজকে বলেন, পাখি নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার জন্য পাখির পায়ে রিং পরানোর এই কার্যক্রম ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর আমাদের দেশে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কালচে ফুটকি (Dusky Warbler), ব্লাইদের নলফুটকি (Blyth’s Reed Warbler), দাগি ঘাসপাখি (Striated Grass-bird), লালবুক গুরগুরি (Ruddy-breasted Crake), ল্যাঞ্জা লাটোরা (Long-tailed Shrike) প্রভৃতি প্রজাতির প্রায় ৩৭০টি পাখির পায়ে রিং পরানো হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ২০১০ সালে ২২ নভেম্বর থেকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব এবং দি ওয়েটল্যান্ড ট্রাস্ট-এর উদ্যোগ সোনাদিয়া দ্বীপে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো 'বার্ড রিংগিং' ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়। এই চার-পাঁচ বছর ধরে আমরা যতগুলো পাখির পায়ে রিং পরিয়েছি সবগুলো পাখির তথ্যই ওয়েবে প্রকাশ করা রয়েছে। ইংল্যান্ডে প্রায় ১০০ বছর ধরে এই বার্ড রিংগিং কার্যক্রম চলছে।
বার্ড রিংগিংয়ের একটি অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ওমর শাহাদাত বলেন, হাকালুকি হাওরে বার্ডরিংগিংয়ের সময় কসাই পাখি বলে পরিচিত ল্যাঞ্জা লাটোরা পাখিটির আঁচড়ে কামড়ে ব্রিটিশ পাখি রিংগিং প্রশিক্ষক স্টিভেন স্যামওয়ার্থের ডান হাতে মুহূর্তে রক্ত বের হয়ে যায়।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৫