ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

দুরন্তপনা নয়, খাবারের আকুতি রোগাটে হরিণের!

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৫
দুরন্তপনা নয়, খাবারের আকুতি রোগাটে হরিণের! ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সুন্দরবন থেকে ফিরে: কেউ গেলে তার কাছেই দৌঁড়ে আসছে হরিণগুলো। কোনোটি রডের ফাঁক দিয়ে মাথা বের করে হাত শুকছে, খাবার আছে কি-না?
 
একজন বিস্কুট ধরতেই তার ওপর হামলে পড়ার মতো অবস্থা।

১২টি হরিণ একসঙ্গে রডের ফাঁক দিয়ে মাথার বের করে বিস্কুট ধরার চেষ্টা করছিল। ছোট্ট একটি লেক্সাস বিস্কুটের প্যাকেটে কতোটুকুই বা ‍থাকে! নিমিষেই শেষ হয়ে গেলো। কারো কারো ভাগ্যে জুটল, বেশিরভাগকেই নিরাশ হতে হলো।
 
বিস্কুট শেষ। কিন্তু ক্ষুধার তাড়না হরিণগুলোকে পেছনে ফিরতে বাঁধা দিচ্ছিল। বিস্কুট দেওয়া মানুষটি যতোক্ষণ থাকলেন ততোক্ষণ গলা ‍বাড়িয়েই থাকলো ওরা। কোনো কোনোটি আবার তার হাতের তালুতে মুখ গুঁজে দিচ্ছিল, খাবারের খোঁজে। খাবারের জন্য কি প্রাণপন প্রচেষ্টা হরিণগুলোর।

দুরন্তপনা আর ছোটাছুটি করে দর্শণার্থীদের মন ভরিয়ে দেওয়ার কথা ছিল হরিণগুলোর। অথচ তাদেরকেই খাবারের জন্য করুণা ভিক্ষা করে বেড়াতে হচ্ছে দর্শণার্থীদের কাছে।

সুন্দরবনের বাফার জোনে অবস্থিত করমজল বন্যপ্রাণী প্রজণন কেন্দ্রে থাকা হরিণগুলোর এ করুণদশা মন খারাপ করে দেয় সেখানে আসা দর্শণার্থীদেরও।  
সম্প্রতি নেপালের চিড়িয়াখানা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো। সেখানে কোনো হরিণকে খাবারের জন্য এভাবে ছুটতে দেখা যায় না। খাঁচার পাশ দিয়ে কে গেলো না গেলো সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ থাকে না হরিণগুলোর।
 
নেপালের চিড়িয়াখানার খাঁচাগুলো বাহারি গাছে ভরপুর। খাঁচার ভেতরে থাকা গাছগুলো আলাদা করে নেট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ঠিক যেনো খাঁচার মধ্যে আরেকটি খাঁচা। নেটের ফাঁক গলে বের হয়ে আসা পাতাগুলো মনের সুখে কুটে কুটে খায় হরিণগুলো। আবার খাঁচার বাইরেটা গ্রিন বেল্ট দিয়ে ঘেরা।
 
কিন্তু এখানে ধু-ধু বালি, ঠিক যেন মরুভূমির আবহ তৈরি করা হয়েছে। এখানে দেখে হরিণকে মরুভূমির প্রাণী ভাবলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
 
প্রায় একবিঘা জুড়ে হরিণের খাঁচাটি। কোমর প্রাচীরে ঘেরা। আর সেই প্রাচীরের ওপর ১০ ইঞ্চি ফাঁক করে লোহার পাইপ দেওয়া হয়েছে। বাইরে থেকে হরিণগুলো দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু হরিণগুলো যাতে বাইরে বের হতে না পারে সেজন্য এভাবেই ডিজাইন করা।

এ কেন্দ্রে হরিণ ছাড়াও ৬টি শেড রয়েছে কুমিরের। হরিণের খাঁচার একপাশে ওয়াচ টাওয়ারের মতো উঁচু একটি খাঁচায় কতোগুলো বানর রয়েছে। যদিও এখানে উন্মুক্ত অনেক বানরের দেখা পাওয়া যায়।
 
ঘড়িতে তখন সকাল ৮টা ১০ মিনিট। তখন পর্যন্ত কোনো খাবার দেওয়া হয়নি হরিণগুলোকে। আগেরদিন খাবার দেওয়া হলে উচ্ছিষ্ট ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কথা। কিন্তু তার চিহ্ন পর্যন্ত দেখা গেলো না খাঁচার ভেতরে। এমনকি খাঁচার মধ্যে কোথাও একটি গাছের পাতাও পড়ে নেই।
 
বন্যপ্রাণীর সঙ্গে খাবার নিয়ে এমন তামাশা দর্শণার্থী সকলেরই দৃষ্টিগোচর হলো। দৈনিক সমকালের সিনিয়র সাংবাদিক রফিকুল বাসার বলে উঠলেন, ‘হরিণগুলোর কি করুণ অবস্থা। বন এলাকার এ খাঁচায় ওদের চেহারা নাদুস-নুদুস থাকার কথা। কিন্তু বেশিরভাগ হরিণের চেহারা রোগাটে হয়ে গেছে। যা দেখলাম, তাতে কষ্ট নিয়ে ফিরতে হলো’।
 
এখানে ৪৯টি হরিণ রয়েছে বলে জানালেন প্রজনন কেন্দ্রের বনপ্রহরী বিধান চন্দ্র মহলদার। তিনি হরিণগুলোর খাবারের জন্য আকুতিতে পাত্তাই দিলেন না। বাংলানিউজকে বিধান বললেন, ‘বন্যপ্রাণীকে যতো খাবার দেবেন ততোই খাবে। ওদের পেট ভর্তি থাকলেও আরও খেতে চাইবে। কখনোই না করবে না’।
 
কখন কখন খাবার দেওয়া হয় জানতে চাইলে বলেন, সকাল ৮টা, দুপুর দেড়টা আর বিকেল ৫টায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত (ততোক্ষণে ঘড়িতে সময় সকাল পৌনে ৯টা) কোন খাবার দেওয়া তো হলো না?-প্রশ্নের জবাবে বিধান চন্দ্র মহলদার জবাব দিলেন, আসলে পশুর নদীর ওপার থেকে খাবার নিয়ে আসে তো। তাই কখনও কখনও একটু দেরি হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার চলে আসবে।
 
এরপর আরও ৪০ মিনিটের মতো অবস্থান করলেও সেখানে খাবার আনতে দেখা গেলো না।
 
খুলনা সিটি থেকে নদীপথে গেলে করমজল হয়ে সুন্দববনে প্রবেশ করতে হয়। নদীর পূর্বতীরে প্রায় ৫০ একর জমিতে অবস্থিত করমজল বন্যপ্রাণী প্রজণন কেন্দ্রটি। পশ্চিম ঘেঁষে বয়ে চলেছে পশুর চ্যানেল। আর পশুর চ্যানেল থেকে বের হয়ে খানিকটা ধনুকের মতো একটি নদী করমজলকে সমতল ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।
 
এখানে প্রবেশ করতে হলে প্রথমে টিকিট করতে হয়। টিকিটের মূল্য দেশি পর্যটকদের ২৩ টাকা, বিদেশি পর্যটকদের ৩৪৫ টাকা, শিক্ষার্থীদের ২৩ টাকা, গবেষকদের ৪৬ টাকা, বিদেশি গবেষকদের ৫৭৫ টাকা এবং ১২ বছরের নিচে শিশুদের জন্য সাড়ে ১১ টাকা। এখানে ভিডিও ক্যামেরা ব্যবহারের জন্য আলাদা চার্জ দিতে হয়। দেশি পর্যটকদের ভিডিও ক্যামেরার চার্জ ২৩০ টাকা এবং বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে ৩৪৫ টাকা আদায় করা হয়।
 
মংলা নদীবন্দরের খুব কাছের এই স্পটটিতে খুলনা শহর থেকে নৌকায় যাওয়া যায়। আর নৌকা থেকে নামার পরই টিকিট কাউন্টার। কাউন্টারের পরেই রয়েছে 
 
প্রাণীর খাঁচাগুলো। বাইরের পুরো এলাকা নানা প্রজাতির গাছে ভরপুর। রয়েছে একটি ওয়াচ টাওয়ার। আবার বনের ভেতর দিয়ে চার ফুট উ‍ঁচু ওয়াকওয়ে রয়েছে। কংক্রিটের সরু ওভারব্রিজের মতো এ ওয়াকওয়েতে কাঠের পাটাতন বিছানো রয়েছে।
 
এখানে দেখা মিলবে হরেক প্রজাতির কাঁকড়ার। যেমন তাদের চেহারা, তেমনি বাহারি রঙ। ঠিক যেন সং সেজেছে ওরা। ওয়াকওয়েতে দাঁড়ালেই দেখা যায় তাদের খেলা। তবে সামান্য শব্দ করলেই গর্তে মুখ লুকিয়ে ফেলে। আবার কোনো কোনোটি পাল্টা আক্রমণের জন্য রণপ্রস্তুতি নেয় নখ উ‍ঁচিয়ে।
 
গহীন জঙ্গলের তীরে যেখানে গিয়ে মিশেছে ওয়াকওয়ে, সেখানে রয়েছে একটি গোলঘর। এর চারপাশে পাতা রয়েছে কংক্রিটের বেঞ্চ। তাতে বসলে ঝিঝি পোকার শব্দ, আর মাঝে মধ্যে বানরের হই-হুল্লোড় মনকে রোমাঞ্চিত করে তুলবে। সঙ্গে নির্মল বাতাস গেঁথে রাখবে স্মৃতির মানসপটে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৫
এসআই/এএসআর

** অচিহ্নিত-অনিরাপদ অদ্ভুত এক নৌ-রুট!
** স্যার এবারের মতো...
** যে গ্রামে ৯০ শতাংশ বাল্যবিয়ে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।