২০১৯ এর বিষণ্ন এক সন্ধ্যা। সাকিব আল হাসানের জন্য? জীবনের সবচেয়ে বাজে দিন! সাদা গাড়িতে চড়ে তিনি আসলেন।
ক্যামেরা, লাইট, বুম, মোবাইল ফোন; কত কত ডিভাইসের চোখ সাকিবে। তিনি? হয়তো দুনিয়ায় সবকিছু আড়াল করা যায় কি না এমন মেশিনের খোঁজে! সাকিব জানেন, আজ তার ডুবে যাওয়ার দিন। নিজেকে হারিয়ে ফেলার সময়।
একরকম লুকিয়ে বিসিবি সভাপতির কাছে পৌঁছান। কথাবার্তা শেষে তাকে সঙ্গে নিয়েই বেড়িয়ে আসেন। ছলছল চোখ বলে দেয় মনের কথা। তবুও তাকে পড়তে হয় অনেক কিছু। জুয়াড়ি প্রস্তাব দিয়েছিল, গ্রহণ করেননি, জানানওনি সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে। সাকিব তাই নিষিদ্ধ হন এক বছরের জন্য।
রঙ হারানো সাকিব বলেন, ‘যে খেলাকে সবচেয়ে ভালোবাসি সেখান থেকে নিষেধাজ্ঞা পেয়ে আমি খুবই দুঃখিত। তবে অনৈতিক প্রস্তাবের ব্যাপারটি আইসিসি ও আকসুকে না জানানোয় যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, তা আমি মাথা পেতে নিচ্ছি...’
সাকিব মাথা পেতে নেন আরও অনেক কিছু। খেলাটা তাকে অনেক কিছু দিয়েছিল, এখন তার সময় হয়েছিল ফেরানোর। তখনই হলেন নিষিদ্ধ। পরিণত সাকিবকে অধিনায়ক হিসেবে না পাওয়ার আফসোসে পুড়ল দেশের ক্রিকেট। তিন ফরম্যাটেই নেতৃত্ব পেয়েছেন, তখনও তো বেশিদিন হয়নি!
***
বছর তিনেক পর।
এবারের গল্পটা আলাদা, গুলশানের আইভী টাওয়ারের। সাংবাদিকদের জটলা এখানেও। অপেক্ষাটা সাকিবের জন্যই ছিল, সম্ভাবনা ছিল তার আসারও। সন্ধ্যার পর এলেন মুমিনুল হক।
প্রিন্টের একটা শার্ট। পরনে প্যান্ট। শুকিয়ে যাওয়া মুখ। সাধাসিধে মুমিনুল এলেন কালো গাড়িতে চড়ে। গাড়ির দরজাটা খুলতেই ‘মৌমাছি’ হলো শত শত ডিভাইস। বিষণ্ন মুখের একটা ছবি যে ভীষণ দরকার।
মুমিনুল নামলেন। তিনি সোজা ঢুকে গেলেন বাসায়। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন এখানেই থাকেন। তার সঙ্গে আলাপ শেষ করে বাড়ির নিচে এসে মুমিনুল যেন লুকানোর জায়গা খুঁজলেন; সাকিবের মতো? কে জানে!
সাকিব অপরাধ করেছিলেন, মুমিনুল করেননি। সাকিবের হাতে একটা আগের লেখা বক্তব্য ছিল, মুমিনুলের তাও নেই। তবুও পরিবেশটা দাঁড়িয়ে গেল একই রকম। ‘আমার অপরাধটা কী?’ মুমিনুল বলেছিলেন কি না, কে জানে!
তবে তিনি তথৈবচ হয়ে বাসার নিচেই সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘুরলেন অনেকটা। ক্যামেরা ঠিকঠাক হলো, বুম হলো, সব চেক করা শেষে মুমিনুলকে প্রশ্ন করা হলো, ‘মুমিনুল কী কথা হলো?’
যেন এই প্রশ্নটার অপেক্ষাতেই ছিলেন তিনি। মুমিনুল বলতে শুরু করলেন, ‘আপাতত আমি চাচ্ছি ব্যাটিংয়ে মনোযোগ দিতে, আমার জন্য ভালো। যখন আপনি ভালো খেলবেন, দল খারাপ করলেও অনুপ্রেরণা দিতে পারবেন। আমিও ভালো খেলতে পারছি না দলও ভালো করছে না। এই সময়ে অধিনায়কত্ব করা খুবই কঠিন। ’
এরপর একের পর এক প্রশ্ন এল, মুমিনুল কোনোরকমে পাড় করলেন সেসব। মাঝেমধ্যেই বললেন, ‘ভাই, আমি যাই...এত প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কথা ছিল না...’। তবুও মুমিনুল হককে বলতে হলো অনেক কথা।
মুমিনুল বিধ্বস্ত হয়ে থাকলেন পুরোটা সময়। নেতৃত্বের চাপে ব্যাটিংটা ঠিকঠাক নেই- এমন মন্তব্য আসতে শুরু করেছিল। অফ ফর্মের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ‘চিন্তা করছি না’ বলে আরও বাড়াচ্ছিলেন সেটা। সমালোচনা জেঁকে বসেছিল। শেষ অবধি নিজে থেকেই ছেড়ে দিলেন দায়িত্ব। শেষবার এই নেতৃত্ব কে ছেড়েছিলেন? সাকিব আল হাসান! একেই বোধ হয় নিয়তি বলে!
***
দুই দিন পর। এবারের গাড়ির রঙটাও সাকিবের মতোই, তবে নাজমুল হাসান পাপনের। বোর্ড সভা আগে থেকেই ঠিক হয়েছিল, এজেন্ডা হিসেবে ছিল না নেতৃত্বের রদবদল। তবুও এটাই হয়ে গেল মূল আলোচনা।
তিন ঘণ্টার বৈঠক শেষে বেড়িয়ে এলেন নাজমুল হাসান পাপন। আকাশে রোদ, আবহাওয়ায় তীব্র গরম। বাইরে গাড়ির হনহন আওয়াজ। এবারও শত শত শত ক্যামেরা, বুম, লাইট। এসবের ভিড়েই পাপন বললেন, ‘তিনটা নাম এসেছিল, আমরা সাকিবকে অধিনায়ক হিসেবে বেছে নিয়েছি। ’
***
তিনটা আলাদা ক্ষণ। দুটো বিষণ্ন সন্ধ্যা। একেবারে আলাদা প্রেক্ষাপটে একইভাবে দুজন মানুষের ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো। তিন বছরের সময়ের ব্যবধান। অথচ বিন্দু বিন্দু ফোঁটার রেখাগুলো এক- অধিনায়কত্ব।
এক সন্ধ্যা সাকিবের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল অধিনায়কত্ব। আরেক সন্ধ্যা গড়ে দিয়েছে ফিরে পাবার পথ। আলো ঝলমলে শহুরে সন্ধ্যা রঙ বদলেছে। দুবারই পথ খুঁজেছে মুখ লুকানোর, অথচ সাকিবের জন্য কত আলাদা হয়েছে আলো!
আরেকটা বিকেল এনে দিয়েছে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা। পরিণত সাকিব আর অধিনায়কত্ব কখনও এক বিন্দুতে মিলতে পারেনি। দুই সন্ধ্যার আলাদা পথ এবার সাকিব জোড়া লাগাতে পারেন কি না, টিকিট কেটে আপনি চাইলে উপভোগ করতে পারেন তা!
গোধূলির মুখে ক্যারিয়ার। সাকিবের নেতৃত্বে ফেরার ঘোষণাটাও এল দিনের এমন সময়েই। নিয়তি এতগুলো রঙ এক রেখায় মিলিয়ে দিয়েছে। এখন দেশের ক্রিকেটের মঙ্গল কামনাকারীদের একটাই চাওয়া থাকতে পারে- সাকিব আর নেতৃত্বের বন্ধনটাও যেন একই রেখাতে থাকে!
বাংলাদেশ সময়: ২১৫১ ঘণ্টা, জুন ২, ২০২২
এমএইচবি/আরইউ