চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছাত্র আন্দোলনে আহত রমজান আলী আরমান সার্জারির টাকা জোগাড় করতে না পেরে মামার বাসায় গিয়ে উঠেছেন। এরমধ্যে তার শরীরে সার্জারি হয়েছে আটবারের বেশি।
১৮ জুলাই সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে নগরের বহদ্দারহাট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন আরমান।
আরমানের পিতা মো. মনসুর পেশায় রিকশাচালক। নিজের খরচ জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হয় তার। স্ত্রী সন্তানের ঠিকমতো খবরও নিতে পারেন না। আরমানের মা উপায় না পেয়ে আহত ছেলেকে নিয়ে চাচাতো ভাইয়ের বাসায় গিয়ে উঠেছেন। সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারবেন কিনা সে নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে হীরা আক্তারের।
জানা গেছে, নগরের মুরাদপুর এন মোহাম্মদ প্লাস্টিক শো-রুমের পেছনে মোহাম্মদপুর এলাকায় মাসিক ৬ হাজার টাকার ভাড়া বাসায় দুই ছেলে এবং স্বামীকে নিয়ে বসবাস করতেন ছাত্র আন্দোলনে আহত আরমানের পরিবার। আরমানের বড় ভাই আরাফাত উল্লাহ বাকপ্রতিবন্ধী। আরমান মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছে। তবে অভাবের সংসারে পড়ালেখা বেশিদূর এগোয়নি।
দিনমজুর এই কিশোরের বাড়ি রাউজান উপজেলার গহিরা চিকদাইর নোয়াহাট এলাকায়। ১৯ বছর ধরে নগরের মুরাদপুর এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন তারা।
আরমান নগরের মির্জাপুর এলাকায় সিলভারে হাড়ি-পাতিল তৈরির একটি কারখানায় দৈনিক ১৩০ টাকা বেতনে কাজ করতো। ঘটনার দিন ১৮ জুলাই বিকেল সাড়ে পাঁচটায় সে কর্মস্থল থেকে বাসায় ফিরে ঝালমুড়ি খেতে মায়ের কাছ থেকে ২০ টাকা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিল।
কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যায় আরমান আর ফিরে আসে না। সন্ধ্যার দিকে বাইরে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ হিরার কানে ভেসে আসছিলো। ছেলে আরমান ঘরে ফিরে না আসায় চিন্তা বাড়তে থাকে তার। সন্ধ্যা ৭টার দিকে ছেলের খোঁজে বাসা থেকে বের হন হীরা। পাঁচলাইশ ও চান্দগাঁও থানায় গিয়ে ছেলের ছবি দেখায় দায়িত্বরত পুলিশদের। আরমানের কোনো হদিস পাচ্ছিলেন না হীরা। রাত ৮টার দিকে স্বামী-স্ত্রী দুজন যান চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু কেউ আরমানের খোঁজ দিতে পারছিলেন না। সন্তানের হদিস না পেয়ে হতাশ হয়ে বাসায় ফিরেন হীরা আক্তার ও তার স্বামী মনছুর।
হিরা আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, বড় ছেলে আরাফাত উল্লাহ চান্দগাঁও থানাধীন বলিরহাট এলাকার একটি ফার্নিচারের দোকানে কাজ করে। ঘটনার দিন সন্ধ্যার পর বহদ্দারহাট মোড়ে কৌতূহলবশত আরাফাত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের জ্বালিয়ে দেওয়া ট্রাফিক পুলিশ বক্সের ভিডিও ধারণ করে নিজের মোবাইল ফোনে। ১৯ জুলাই সকাল ৭টার দিকে ভিডিওটি খালাকে দেখায় আরাফাত উল্লাহ। ভিডিওটি ধারণ করার সময় আরাফাতকে উদ্দেশ্য করে ‘তোমার ভাইয়ের পেটে গুলি লেগেছে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে’ বলে এক শিশুকে বলতে শোনা যায়। ওই শিশু আরমান ও আরাফাতকে চিনতো।
১৯ জুলাই সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বলির হাটে গিয়ে ওই শিশুর সন্ধান পাওয়া যায়। আগের দিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে বহদ্দারহাট এলাকায় আরমান কীভাবে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল এবং কারা আরমানকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেছে, সে বিষয়ে বর্ণনা দেয় শিশুটি। এরপর দুপুর ১২টার দিকে চমেক হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি বিভাগে গিয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গুলিবিদ্ধ সন্তানের সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু সেদিন হাসপাতালের বেডে অচেতন অবস্থায় আরমানকে দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে জ্ঞান ফিরলে চিকিৎসকেরা আমাকে জানান, আরমান বহদ্দারহাট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়েছে। গুলিতে আরমানের পেটের নাড়িভুড়ি ও প্রস্রাবের রাস্তা ছিড়ে গেছে।
সাতদিন পর ক্যাজুয়ালিটি বিভাগ থেকে ছেলের ছাড়পত্র দেওয়া হয়। বাসায় ফিরে যাওয়ার পাঁচদিন পর আরমানের পা দুটি অবশ হয়ে যায়। এরপর চমেক হাসপাতালের ২৫, ৭৯ এবং ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা চলে আরমানের। ২২দিন চিকিৎসাধীন ছিল সার্জারি ওয়ার্ডের ২৪ নম্বর বেডে। এরপর চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে না পেরে ছেলেকে নিয়ে তার নানার বাড়ি গিয়ে উঠেছেন হিরা আক্তার।
হিরা আক্তার বলেন, আমি আগে গার্মেন্টসে সামান্য বেতনে চাকরি করতাম। ছেলে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর হাসপাতালে দেখাশোনার জন্য ওই চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। গত ১৯ বছর ধরে স্বামী আর দুই সন্তান নিয়ে মুরাদপুরের মোহাম্মদপুর এলাকায় ছয় হাজার টাকায় একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করে আসছিলাম। কিন্তু ছেলের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে সেই বাসাটিও চলতি মাসের শেষে ছেড়ে দিবো। স্বামী পেশায় রিকশাচালক। তিনি নানা রোগশোকে আক্রান্ত। বড় ছেলে বাক প্রতিবন্ধী। ছেলের নানা পরীক্ষা, ওষুধ কেনার পেছনে ব্যয় হয়ে গেছে ৫০ হাজার টাকা। সংসারে তো অভাব। সুদে ৫০ হাজার টাকা নিয়েছি, এখন সেই টাকাও শেষ।
সার্জারি ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা বলেন, গুলিতে আরমানের পেট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রস্রাবের রাস্তাও ক্ষতি হয়েছে। বেশ কয়েকবার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে মলদ্বার ও প্রস্রাবের রাস্তায়। আরও একটি সার্জারির প্রয়োজন আরমানের।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০২৪
বিই/টিসি