ঢাকা, বুধবার, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২২ মে ২০২৪, ১৩ জিলকদ ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

বেঁচে আছেন, তাতেই বিস্মিত তিন শিক্ষক

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৭, ২০১৪
বেঁচে আছেন, তাতেই বিস্মিত তিন শিক্ষক ছবি: সোহেল সরওয়ার/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: জামায়াত-শিবির অধ্যুষিত সাতকানিয়া উপজেলার দুর্গম উত্তর ঢেমশা এলাকার বড়ুয়াপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করতে গিয়েছিলেন তিন শিক্ষক। মনে আতংক ছিল, কিন্তু সেই আতংক ছাপিয়ে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনকেই বড় ভেবেছিলেন মানুষ গড়ার এ তিন কারিগর।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত আতংকই সত্যি হয়েছে।

নির্বাচনবিরোধী জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীদের নির্বিচারে হামলায় আহত হয়ে তারা এখন কাতরাচ্ছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিছানায়।
বেঁচে ফিরেছেন সেটাই এখন বিস্ময় তিন শিক্ষকের কাছে।

গুরুতর আহত তিন শিক্ষক হলেন, সাতকানিয়া সরকারী কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো.জামাল উদ্দিন, সাতকানিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ্য শিক্ষক অনিল কান্তি বড়ুয়া এবং উত্তর ঢেমশা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজিমুল ইসলাম।

হামলাকারীরা নির্মমভাবে থেতলে দিয়েছে জামাল উদ্দিনের দু’হাত। ককটেলের আঘাতে বাম চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না নাজিমুল। আর ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মাথায় গুরুতর জখমের শিকার অনিল কান্তি ‍হারাতে বসেছেন মানসিক ভারসাম্য।

মঙ্গলবার দুপুরে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিন শিক্ষক কথা বলেন বাংলানিউজের সঙ্গে।  
ctg-CMC-12
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মো.জামাল উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমি যে বেঁচে ফিরেছি, আল্লাহর ইচ্ছায় ফিরেছি। আমার জন্য অনেকের দোয়া আছে সেজন্য ফিরেছি। আমি বেঁচে ফিরব সেটা আমি কখনোই ভাবিনি। ’

নাজিমুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘ডাক্তার বলেছে, আমার এক চোখের রেটিনা নষ্ট হয়ে গেছে। আমি বাম চোখে কিছুই দেখতে পারছিনা। আপনারা একটু প্রশাসনকে বলেন, আমাকে সাহায্য করতে। আমি অন্ধ হয়ে গেলে চাকুরি করব কিভাবে ?’

অনিল কান্তি বড়ুয়া বাংলানিউজকে বলেন, ‘এভাবে কোন মানুষ মানুষের উপর হামলা করতে পারে সেটা কল্পনাও করা যাবেনা। বিভৎস এ হামলার দৃশ্য কল্পনা করলে আমি অন্যরকম হয়ে যাচ্ছি। আমার মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন। ’

‘ভোট লইবার মজা বুঝাই দিয়ূম’
উত্তর ঢেমশা এলাকায় বড়ুয়া পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রিজাইডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন জামাল উদ্দিন। সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ছিলেন অনিল ও নাজিমুল।

তারা বাংলানিউজকে জানান, ভোটের আগের দিন নির্বাচনী সরঞ্জাম নিয়ে তারা ভোটকেন্দ্রে পৌঁছালেও নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ তাদের ইউনিয়ন অফিসে নিয়ে রাখেন। ভোরে তাদের গাড়ি রেখে হেঁটেই কেন্দ্রে ফিরতে হয়েছে। রাতের আঁধারে গাছ ফেলে সব সড়কই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কেন্দ্রে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল দু’জন পুলিশ আর ১১ জন আনসার সদস্য।

জামাল উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, সকাল ১০টা থেকেই আমরা হামলার বিষয়ে আঁচ করছিলাম। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলার পরও তারা আসছি, আসব করে আসেননি। আবার হামলার সময় ফোন করলেও তারা বলেছে, রাস্তায় গাছ থাকায় তাদের আসতে সময় লাগছে।

জামাল উদ্দিনের বর্ণনায়, বেলা সাড়ে ১২টার দিকে চারদিক থেকে শ’দুয়েক লোক ধর, ধর করে এসে স্কুলে হামলা করে। তাদের হাতে ছিল ধারালো অস্ত্রশস্ত্র, ককটেল। ভয়ে নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা তিন-চারজন স্কুলের একটি কক্ষে আশ্রয় নেয়। স্কুলে টেবিল-চেয়ারগুলো জড়ো করে ভাঙ্গা দরজা কোনভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু জানালা ভেঙ্গে তাদের লক্ষ্য করে ককটেল মারতে থাকে দুর্বৃত্তরা। পরে দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে নির্বিচারে কোপাতে থাকে। আর মুখে বলতে থাকে, ‘ভোট লইতি আর আইবি না, ভোট লইবার মজা বুঝাই দিয়ূম’।
ctg-CMC-2
শুধু হামলা নয়, চলে লুটপাটও
নির্বাচনবিরোধী জামায়াত-শিবিরের লোকজন শুধু হামলা চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, জামাল উদ্দিন এবং অনিল কান্তি বড়ুয়ার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গেছে টাকা ও মোবাইল।

জামাল উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, আমাকে কয়েকজন ফেলে কোপাচ্ছিল। নির্বিচারে হামলায় ক্লান্ত হয়ে আমি যখন মেঝেতে পড়ে যাই, তখন একজন আমার প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেই। এক পকেট থেকে নির্বাচনী খরচের জন্য রাখা ১৫ হাজার টাকা, আরেক পকেট থেকে ব্যক্তিগত ৫ হাজার টাকাসহ মোট ২০ হাজার টাকা এবং শার্টের পকেট থেকে মোবাইল ফে‍ানটি ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায়।

অনিল কান্তি বড়ুয়া বাংলানিউজকে জানান, বাসায় চুরি হয়ে যাবে ভেবে তিনি বেতনের ১২ হাজার ৫’শ টাকা পকেটে নিয়েই ভোটকেন্দ্রে চলে গিয়েছিলেন। হামলার সময় কয়েকজন তার মাথায়, পিঠে আঘাত করছিল আর একজন তার হাতে থাকা মোবাইল ফোনটি নেয়ার জন্য ঝাপটা দেয়। এতে মোবাইল ফোনটি হাত থেকে পড়ে যায়। আর একজন পকেটে হাত ঢুকিয়ে টাকাগুলো নিয়ে নেয়।

তিনি জানান, হামলার সময় তার হাতে থাকা একটি ব্যাগে একটি ‍কাশ্মিরী শাল, একটি লুঙ্গি আর টর্চ ছিল। সেগুলোও নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা।

অনিল বড়ুয়া বাংলানিউজকে বলেন, মাথায় কোপ দেয়ার পর চারদিকে রক্ত দেখে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। হঠাৎ জ্ঞান ফিরলে শুনি মোবাইলের রিংটোন। মোবাইলটি হাতড়ে নিয়ে দেখি আমার ভাই ফোন করেছে, রিসিভ করে বলি, ভাই আমারে বাঁচা। চিৎকার করে বলি, কে কোথায় আছ, আমরা তো মরে যাচ্ছি, আমাদের বাঁচাও।

ভোটকেন্দ্রে এমন হামলা দেখেননি তারা
অনিল কান্তি বড়ুয়া সামরিক শাসক এরশাদের আমলে ৮৬’র নির্বাচনে বাঁশখালীতে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ৯৬’র ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কিন্তু এমন বর্বরতা কিংবা পুলিশের এমন নিস্ক্রিয় ভূমিকা দেখেননি তিনি।

অনিল কান্তি বড়ুয়া বাংলানিউজকে বলেন, ৮৬’র নির্বাচনে বাঁশখালীতে জাতীয় পার্টির মাহমুদুল ইসলামের লোকজন কেন্দ্র দখল করতে এসেছিল। পুলিশ অস্ত্র হাতে নিয়ে বুক পেতে দিয়ে ভোটকেন্দ্র রক্ষা করেছে।  

জামাল উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, আমি ১৮ বছর ধরে শিক্ষকতা করছি। ইউপি নির্বাচন, জাতীয় নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু কখনও এ ধরনের সহিংসতার মধ্যে পড়িনি।
ctg-CMC-320
তিনি বলেন, ইউপি নির্বাচনে দু’প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে মারামারি দেখেছি। কিন্তু ভোটকেন্দ্রে হামলা করা কিংবা নির্বাচনী কর্মকর্তাদের গায়ে হাত তোলার সাহস কারও মধ্যে দেখিনি।

প্রশাসনের উপর ক্ষোভ তিন শিক্ষকের
সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী নাজিমুল ইসলাম জানান, হামলায় আহত হবার পর তাদের প্রথমে সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ডাক্তাররা তাদের বলছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে যেতে আর পুলিশ গিয়ে বলছে, ভোটকেন্দ্রে চলে যেতে।

নাজিমুল ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, আমরা তিনজন তখন মৃত্যুপথযাত্রী। অথচ ওসি-ইউএনও আমাদের চাপ দিচ্ছেন কেন্দ্রে যেতে। তারা হাসপাতালে পাঠানোর জন্য কোন গাড়ির ব্যবস্থাও করেননি। পরে আমরা নিজেরাই দু’হাজার টাকা দিয়ে গাড়ি ভাড়া করিয়ে চমেক হাসপাতালে আসি।

অনিল কান্তি বড়ুয়া বলেন, আমাদের উপর যখন হামলা হয়, পুলিশ তখন ফাঁকা গুলি করছিল। এ গুলিও একসময় শেষ হয়ে যায়। তখন পুলিশ আর প্রতিরোধই করতে পারেনি।

তিনি বলেন, আগের রাত থেকেই ভোটকেন্দ্রের পরিস্থিতি আতংকজনক, থমথমে ছিল। তাহলে সেই কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হল না কেন ?

জামাল উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, আগের রাতেই যখন নিরাপত্তাহীনতার কারণে আমাদের ইউনিয়ন অফিসে নিয়ে যাওয়া হল, তখন প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা উচিৎ ছিল। এভাবে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আমাদের ওই ভোটকেন্দ্রে পাঠানো উচিৎ হয়নি।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫০ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৭,২০১৩
সম্পাদনা: তপন চক্রবর্তী, ব্যুরো এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।