ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

শ্রমিকের পক্ষ নিয়ে সব হারালো জাকির

মো.মহিউদ্দিন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১, ২০১৪
শ্রমিকের পক্ষ নিয়ে সব হারালো জাকির ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: ১৯৮৫ সালে বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের চট্টগ্রাম কারখানায় অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজে যোগ দেন মো. জাকির হোসেন। কর্মদক্ষতার বিবেচনায় তাকে ১৯৮৯ সালের ১৯ এপ্রিল স্থায়ী করা হয়।



শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় এগিয়ে আসায় ১৯৯২ সালে বার্জার পেইন্টস শ্রমিক ইউনিয়নের সহসভাপতি পদে নির্বাচিত হন তিনি। তিন বার নির্বাচিত হয়ে ১৯৯৮ সাল অবধি একই পদে বহাল থাকেন।


কিন্তু খেটে খাওয়া শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়ে কথা বলাই কাল হলো জাকিরের। প্রশাসনের তোপের মুখে পড়েন এ শ্রমিক নেতা। ফলে হারাতে হয় চাকরি। ২০০০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তিনি চাকুরিচ্যুত হন।

শুধু চাকরিচ্যুত করেই ক্ষান্ত হয়নি প্রশাসন। প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যাতে দাঁড়াতে না পারে সেজন্য ভাড়াটে বাহিনী দিয়ে হামলা চালানো হয় এ শ্রমিকের ওপর। এতে পঙ্গু হয়ে যান জাকির।

এরপর ছয় মাস হাসপাতালের বিছানায় কাটিয়ে এখনো সহজে চলাফেরা করতে পারেন না। এ অবস্থায় তাকে ছেড়ে গেছে স্ত্রীসহ আদরের দুই সন্তান। ছেলের কষ্ট দেখেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে জাকিরের বাবা-মা।

জাকিরের অভিযোগ, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের চট্টগ্রাম কারখানার লেবার রিলেশন অ্যান্ড অ্যাডমিন ম্যানেজার এএমএম সাজ্জাদের নির্দেশেই তার ওপর পরিকল্পিতভাবে হামলা করা হয়।

সেই বিভীষিকাময় মূহূর্তের কথা স্মরণ করলে এখনো শিউরে ওঠেন জাকির। কিন্তু ঠিকমতো ক্ষোভের কথাও উচ্চারণ করতে পারেন না। কারণ সন্ত্রাসীদের হামলায় তার দেহের একটি অংশ প্রায় অচল।

জাকির জানান, চাকরি চলে যাওয়ার মজুরি করে কোনোভাবে সংসার চালিয়ে যাচ্ছিল সে। কিন্তু ২০১০ সালে নগরীর সিটি গেইট এলাকায় কাজ করার সময় হামলা হয়। এরপর থেকে স্বাভাবিক চলাফেরাও করতে পারছেন না তিনি।  

বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের চট্টগ্রাম কারখানায় শুধু জাকিরের ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটেনি। শ্রমিকদের পক্ষে থাকায় এ পর্যন্ত ১২ জন শ্রমিক নেতাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। চারজনকে হয়রানিমূলক বদলি করা হয়েছে। সম্প্রতি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক গোলজার হোসেনকে চাকরিচ্যুত করার সব ধরনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে বহুজাতিক এ প্রতিষ্ঠানটি।

এদিকে শ্রমিক নেতাদের অভিযোগ, চট্টগ্রাম কারখানার লেবার রিলেশন অ্যান্ড অ্যাডমিন ম্যানেজার এএমএম সাজ্জাদের কথা অনুযায়ী সংগঠনের নেতারা সংগঠন পরিচালনা না করলে তাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনেন।

প্রথমে তার কথামতো সংগঠন চালানোর নির্দেশ দেন। শ্রমিক নেতারা তা না মানলে তাদের চাকরিচ্যুত করার ব্যবস্থা করেন।

শ্রমিক ইউনিয়নের কর্মকাণ্ডের মনোভাব ব্যাখ্যা করে একজন শ্রমিক নেতা বাংলানিউজকে বলেন, প্রশাসনের কথা হচ্ছে শ্রমিক ইউনিয়ন থাকবে নাম সর্বস্ব। কোনো কার্যক্রম থাকবে না। আমরা যা করতে বলি তাই করতে হবে।

সাজ্জাদের মনমতো না হলেই শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। শ্রমিক ইউনিয়ন করার আইনি অধিকার থাকলেও প্রশাসনের ইচ্ছামতো চলতে হয়।

অনিয়ম ঢাকতে চাকরিচ্যুত:
এএমএম সাজ্জাদের অনিয়ম দুর্নীতি ঢাকতেই শ্রমিক নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কারণ প্রতিষ্ঠান সব ধরনের সুবিধা দিলেও অনিয়মের আশ্রয় নেন তিনি। এসব অনিয়ম দুর্নীতির কথা অনেক শ্রমিক নেতাই জানেন। ফলে তার গোপন তথ্য কোম্পানির কাছে ফাঁস হয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কা থেকেই শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করার ব্যবস্থা করেন।

সম্প্রতি তার এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কোম্পানির জিএম (এইচআর) হোমাইরা ফাতেমা হামিমের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক গোলজার হোসেন।

অভিযোগে বলা হয়, বিখ্যাত এ প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় কর্মকর্তারা শ্রমিকদের যে নির্যাতন করছে তার কোনো উদাহরণ নেই। অথচ শ্রমিক নির্যাতন করেও মাসে মোটা অঙ্কের বেতনসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করছেন। শ্রমিকের শ্রমে-ঘামে উৎপাদিত পণ্যের বিপরীতে শ্রমিকেরা লাভবান না হলেও এ প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার এএমএম সাজ্জাদ অঢেল সম্পত্তির মালিক বনে গেছেন।

আমিই আইন তৈরি করি:
ইউনিয়নের কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়ায় যুগ্ম শ্রম পরিচালকের কাছেও অভিযোগ দিয়েছেন গোলাজার। সেখানে কোম্পানির লেবার রিলেশন অ্যান্ড অ্যাডমিন ম্যানেজার এএমএম সাজ্জাদ ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের কাজে দীর্ঘদিন ধরে বাধা দিয়ে আসছেন বলে অভিযোগ করা হয়।

অভিযোগ বলা হয়, ‘তিনি (এএমএম সাজ্জাদ) বলিয়া আসিতেছেন আমি লেবার কোর্টের মেম্বার। আমিই আইন তৈরি করি। আমাকে আইন শিখাইতে হবে না। আমি যা খুশি তাই করিব। ইউনিয়ন টিউনিয়ন বুঝি না। বুঝাইবার চেষ্টাও করিবে না। যদি কোনো রকম দাবি নিয়ে আস তাহলে চাকুরিচ্যুত করা হবে। অতীতেও অনেক ইউনিয়ন কর্মকর্তাকে চাকুরিচ্যুত করেছি। তারা কিছুই করতে পারেনি। তোমরাও পারবে না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে তোমাদেরকেও চাকুরিচ্যুত করিব। ’

প্রসঙ্গত, গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর এ অভিযোগ দেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। তার ঠিক দুমাস পর চাকরি থেকে সাসপেন্ড করার সুপারিশ করা হয়। এরপর ৪ ডিসেম্বর তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এ আদেশের বিরুদ্ধে তিনি আজও আইনি লড়াই করে যাচ্ছেন।

চাকরি হারানো ১০ শ্রমিক:
শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায়ে কাজ করায় এ পর্যন্ত ১২ জন শ্রমিক নেতাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তিনজনকে চট্টগ্রাম থেকে দেশের বিভিন্ন কারখানায় বদলি করা হয়েছে।

বর্তমান সাধারণ সম্পাদক গোলাজার হোসেনকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে তিনি আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ায় এ বিষয়ে কোনো সমাধান হয়নি।

বিভিন্ন মেয়াদে বিভিন্ন পদে থাকা ১১ শ্রমিক নেতার মধ্যে আছেন সহসভাপতি জাকির হোসেন, সভাপতি মো. আলম, অর্থ সম্পদ সালাউদ্দিন খান, সহসভাপতি বশির আহম্মদ, জ্যেষ্ঠ সদস্য শাহিন, হান্নান মুন্সি ও মিলন, সাধারণ সম্পাদক অনিল চন্দ্র সিনহা, মুকল সেন গুপ্ত, সহসভাপতি তাজুল ইসলাম এবং দিদারুল আলম।

এ ছাড়া সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন, সহসাধারণ সম্পাদক মো. জসিম, জ্যেষ্ঠ সদস্য মো.জাকির হোসেনকে চট্টগ্রাম কালুরঘাট কারখানা থেকে খুলনা ও বরিশাল ছাড়াও বিভিন্ন কারখানায় হয়রানিমূলক বদলি করা হয়।

চাকরি হারানো সহসভাপতি দিদারুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, শ্রমিকদের পক্ষে যারা মাথা উঁচু করে কথা বলবে যেকোনোভাবে তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়। কর্মকর্তাদের কথা ‍অনুযায়ী কাজ না করলে চাকরি হারানোর সঙ্গে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতে হয় বলে অভিযোগ করেন তিনি।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য:
অভিযুক্ত এএমএম সাজ্জাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি পরে কথা বলবেন বলে মোবাইলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। পরে তার মোবাইলে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।

এরপর সংশিষ্ট কর্মকর্তা কোম্পানির জিএম (এইচআর) হোমাইরা ফাতেমা হামিম’র সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ব্যস্ত আছেন বলে সংযোগ কেটে দেন।

কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী এ দুই কর্মকর্তা সংশিষ্ট হলেও তারা এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা না বলার কারণ ব্যাখ্যা করলেন কোম্পানির জিএম ম্যানুফেকচারিং অ্যান্ড ডিরেক্টর (জেএনএন, মেনসন অ্যান্ড নিকলেসন) নাজিম উদ্দিন হেলালী। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আসলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা হলেও এসব বিষয় আমিই ডিল করি। তাই তারা কথা বলছেন না।

প্রতিষ্ঠানের আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন।

বাংলাদেশ সময়: ১২০২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২, ২০১৪
সম্পাদনা: তপন চক্রবর্তী, ব্যুরো এডিটর/সাব্বিন হাসান, আইসিটি এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।