ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

বন্ধুদের কফি খাওয়াতে লেখা শুরু করেছিলেন সমরেশ !

ইফতেখার ফয়সাল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩০০ ঘণ্টা, মার্চ ২, ২০১৪
বন্ধুদের কফি খাওয়াতে লেখা শুরু করেছিলেন সমরেশ !

চট্টগ্রাম: জীবনের কোন মহৎ উদ্দেশ্য সামনে রেখে নয়। সহপাঠিদের কফির টাকার  যোগান দিতেই লেখালেখি শুরু করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তিতুল্য কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার।



রোববার নগরীর গ্রন্থবিপনী ‘বাতিঘর’ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে পাঠকদের লেখালেখি শুরুর সেই গল্প শোনালেন জনপ্রিয় এই কথাসাহিত্যিক।

‘আমার জীবন, আমার ভাবনা’ শীর্ষক এ আয়োজনে এছাড়াও নিজের জীবনের সাতকাহন শুনিয়ে পাঠকদের মুগ্ধ করেন ‘সাতকাহনে’র এই স্রষ্টা।
এসময় পাঠকদের নিজের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি।

সমরেশ বলেন, লিখব এ চিন্তাটা কখনোই মাথায় ছিলো না। থিয়েটার করতাম। নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখতে না পেরে গল্প লিখলাম। গল্পটি পত্রিকায় ছাপা হলে ১৫ টাকা মানি অর্ডার পাই। সেই টাকায় বন্ধুদের নিয়ে কফি খেয়েছি। বন্ধুদের সে কি উল্লাস! কফির টাকার যোগান দিতে তারা আরো লিখতে উৎসাহিত করলো। সেই থেকে আর লেখা থামেনি।

সুন্দরীদের পটাতে কবিতা লিখতে ছেয়েছিলেন সমরেশ
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কোথাও গেলে সুন্দরীরা তাকে ঘিরে ধরতো। সুনীলের কবিতার প্রশংসা করতো। সুনীলের এ অর্জনে ঈর্ষাকাতর হয়ে কবিতা লিখতে চেয়েছিলেন সমরেশ। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।



সমরেশের ভাষায়, সুনীল কবিতার জোরে সকল সুন্দরীদের জয় করে নিয়েছেন। আমিও লিখতে চেয়েছিলাম। পারিনি। যা এগারোই হয় না, তা এক জন্মেও হয় না। বুঝেছি কবিতা লেখা আমার দ্বারা হবে না।

সারা জীবন শুধুই অভিনয়
তারাশঙ্কর, সুনীল, শীর্ষেন্দু’সহ কয়েকজন লেখকের নাম উল্লেখ করে সমরেশ বলেন, উনাদের সাহিত্যের ধারে কাছেও যাওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। আমি সারাজীবন লেখকের ভান করেছি। এমনভাবে অভিনয় করেছি যাতে কেউ বুঝতে না পারে। সফল হয়েছি। এখনো সন্তর্পনে সে অভিনয় করে চলছি।

ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই সমরেশের
সমরেশের উপন্যাসের বেদনাবিধুর জীবনের সঙ্গে উপন্যাসিকের বাস্তব সাক্ষা‍ৎ কতটুকু, এক পাঠকের এমন প্রশ্নের জবাবে সমরেশ বলেন, আমার বেড়ে উঠা এক দরিদ্র পরিবারে। পিতা, পিতামহ তাদের দারিদ্রতা আমাকে বুঝতে দিতেন না। তাদের দেখে খুব কষ্ট হতো। ভাবি আমার আরো আগে কেন আর্থিক সক্ষমতা এলো না। তাহলে তাদের দুঃখ কিছুটা গোছাতে পারতাম। আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না। তবুও মনের অজান্তেই এখনো তাদের প্রত্যাশা করি। ভাবি, তাদের আবার যদি ফিরে পাই কষ্টের দিনগুলোকে ভুলিয়ে দেবো।

শ্রমজীবী, নিম্নবিত্ত মানুষদের এড়িয়ে চলা অথবা মদের গল্প
সমরেশ বলেন, বাংলার মানুষ আবেগ প্রবণ। তাঁদের কাছ থেকে আমি যে ভালবাসা পেয়েছি সারা দুনিয়ায় তার নজির খুব কম আছে। আমার লেখার পাঠকদের অধিকাংশই শ্রমজীবী, নিম্নবিত্ত মানুষ। কোথাও তারা আমাকে চিনলেই এগিয়ে আসে। উপহার দেয়। অহেতুক খরচ করতে চায়। অনেক ট্যাক্সি ড্রাইভারের সিটের পাশে আমি আমার উপন্যাস দেখেছি। পরিচয় দিইনি এই ভেবে, যদি আবার ভাড়া না নেয়।

কথা প্রসঙ্গে নিউইয়ার্কের এক বাঙালি ট্যাক্সিওয়ালার গল্প শোনান সমরেশ। তিনি বলেন, আমার পরিচয় জানতে পেরে একবার মধ্য রাতে এক ট্যাক্সিওয়ালা তাঁর সারাদিনের উপার্জনের অর্ধেক খরচ করে স্কচের বোতল কিনে নিয়ে এলেন। আমি বললাম, আপনাকে কে বললো আমি মদ খাই। ট্যাক্সিওয়ালার উত্তর, কেন শরৎচন্দ্র তো খেতেন। আমি তাঁকে বোতলটি ফেরত নিয়ে যেতে বললে তিনি বললেন, বাসায় নিয়ে গেলে বিপদ, বউ বকা দিবে।

প্রতিদিন ভাবি লিখবনা
কখনো লেখালেখি ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছা আছে কি না পাঠকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সমরেশ বলেন, প্রতিদিনই ঘুম থেকে উঠে ভাবি আর লিখবো না। লেখার ভুত ঘাঁড় থেকে নামানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সেই ভুত আর নামে না।

বামফ্রন্ট-তৃণমূল, শুধুই ক্ষমতার বদল
নিজের উপন্যাসের সামাজিক বাস্তবতা আলোচনা করতে গিয়ে সমরেশ বলেন, বামফ্রন্টের অত্যাচারে মানুষ তৃণমূলকে বেছে নেয়। কিন্তু, পরিবর্তন ক্ষমতার, মূল্যবোধের নয়। আরেকটি পরিবর্তনের জন্য আরো ৩ বছর অপেক্ষা করতে হবে।

৬৭ বছরের বড় পাওনা নারীর উন্নয়ন
সমরেশ জয়িতা, দীপাবলী সহ তাঁর উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, ১৯৪৭ থেকে ২০১৪ এই ৬৭ বছরে কি হয়েছে আমি জানি না। তবে একটি পরিবর্তনের কথা আমি জানি, নারীর উন্নয়ন। অন্দরমহল ছেড়ে নারীরা বের হয়ে আসতে শুরু করেছে। এই সামাজিক বিপ্লব দেখলে আত্মবিশ্বাস জন্মে, এ দেশ আর পিছিয়ে নেই।

নবীন লেখকদের প্রতি
নবীন লেখকদের প্রতি পরামর্শ দিতে গিয়ে সমরেশ বলেন, বেশী করে পড়বেন, কিন্তু ভুলে যাবেন। নিজের মতো করে লিখবেন। নিজের পরিবার, পরিবেশ-প্রতিবেশ, সমস্যা-সমস্যাহীনতাকে তুলে ধরুন। পাঠক আপনাকে খুঁজে নিবে। পাঠকের সঙ্গে মানসিক যোগাযোগ রক্ষা করতে না পারলে লেখক হওয়া সম্ভব না।

চলচিত্র-সাহিত্য, মাংসের ঝোল-মাংসের কাবাব
অনেক সিনেমার জন্য গল্প লিখেছেন সমরেশ। কিন্তু সাহিত্যের গল্প আর সিনেমার গল্প এক কি না পাঠকদের এমন প্রশ্নে সমরেশ বলেন, মাংস দিয়ে ঝোল তরকারিও রান্না হয় আবার কাবাবও হয়। তাই বলে দু’টি জিনিশ এক নয়।
সমরেশ বলেন, সিনেমার গল্প মেয়ে বিয়ে দেওয়ার মতো। প্রযোজকের কাছে যাওয়ার পর তা নিয়ে আর কিছু বলা যায় না।

পাঠকের ভালবাসা শ্রেষ্ট পুরষ্কার
উপস্থিত পাঠকদের উদ্দেশ্যে সমরেশ বলেন, জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছি। কিন্তু আপনাদের ভালোবাসা সমস্ত পুরস্কারকে ছাপিয়ে গেছে।

মাস্টারদা‘কে দিয়ে চট্টগ্রাম চিনেছি
সমরেশ বলেন, প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম এসেছি। মাস্টার দা’ সূর্যসেনের কথা মনে হলেই চট্টগ্রামের কথা মনে আসে। ভাবতে ভালো লাগে, মাস্টারদা’ প্রীতিলতার যে মাঠিতে হেটেছেন সেই মাঠিতেই চট্টগ্রামবাসীর বেড়ে উঠা। চট্টগ্রামবাসীর জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা।

বাংলাদেশ সময়: ২৩০১ ঘন্টা, মার্চ ২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।