ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

বিএসআরএম’র ডিভাইডার এবার ছাত্রলীগের হাতিয়ার

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫০ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০১৪
বিএসআরএম’র ডিভাইডার এবার ছাত্রলীগের হাতিয়ার ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: বেসরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলের (বিএসআরএম) অস্থায়ী রোড ডিভাইডার (সড়ক বিভাজক) দিয়ে ফের চট্টগ্রাম নগরীতে নাশকতার ঘটনা ঘটেছে।

জামায়াত-শিবিরের বছরের পর বছর ধরে সহিংস তাণ্ডবের পর এবার ছাত্রলীগ কর্মীরা নগরীর ষোলশহর দু’নম্বর গেইটে ডিভাইডার দিয়ে গাড়ি ভাংচুরের উৎসবে মেতেছে।



সোমবার সকাল ১১টা থেকে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে দু’নম্বর গেইট এলাকায় বিএসআরএম’র ডিভাইডার দিয়ে এ তাণ্ডব চলে।

সকালে নগরীর খুলশী থানার ষোলশহর দু’নম্বর গেইটে একটি সেপটিক ট্যাংক থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত দু’বন্ধুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
এসময় স্থানীয় ওমরগণি এমইএস কলেজের একদল ছাত্রলীগ কর্মী প্রথমে লাঠিসোঠা নিয়ে ঘটনাস্থলের সামনে সড়কে অবস্থান নেয়।

ঘটনাস্থলে অবস্থান করে দেখা গেছে, ছাত্রলীগ কর্মীরা সড়কে অবস্থান নিয়েই প্রথমে দু’নম্বর গেইট থেকে পুলিশ সুপারের কার্যালয় পর্যন্ত সড়কের ডিভাইডারগুলো এলোমেলো করে ফেলে। বেশ কিছু ডিভাইডার রাস্তায় ছুঁড়ে ভেঙ্গে ফেলে। তারপর ওই ডিভাইডারের বড় বড় ভাঙ্গা অংশ দিয়ে নির্বিচারে গাড়ি ভাংচুর শুরু করে।

ছাত্রলীগ কর্মীদের লাঠিসোঠা ও ডিভাইডারের ভাঙ্গা অংশ নিয়ে এ তাণ্ডবের সময় অনেককে গাড়ি থেকে নেমে এবং অনেক পথচারীকে প্রাণভয়ে দৌঁড়াতে দেখা যায়। প্রায় আধাঘণ্টা পর পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এসময় এলোমেলো করে রাখা ডিভাইডারগুলোকে আবারও সারিবদ্ধ করতে পুলিশকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়।

এর আগে গত প্রায় তিন বছর ধরে জামায়াত-শিবির চট্টগ্রাম নগরজুড়ে বিএসআরএম’র ডিভাইডারগুলোকে সহিংসতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। প্রচারণার জন্য সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ট্রাফিক পুলিশকে সহযোগিতার নামে দেওয়া এসব ডিভাইডার দিয়ে বারবার সহিংসতার ঘটনা ঘটানো হলেও পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা সিটি কর্পোরেশন সেগুলো সড়ক থেকে সরিয়ে নিচ্ছে না।

নগরীতে জামায়াত-শিবিরের সহিংস তাণ্ডবের ঘটনা পর্যালোচনা করে পুলিশ দেখেছে, প্রত্যেক ঘটনাতেই তাণ্ডবকারীরা বিএসআরএম’র অস্থায়ী রোড ডিভাইডারগুলো সড়কে এলোপাতাড়ি করে রেখে অবরোধ সৃষ্টি করেছে। এরপর তারা ওই এলাকায় সহিংস তাণ্ডবে মেতেছে। যানবাহন, দোকানপাট নির্বিচারে ভাঙচুর করেছে। আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করেছে রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সম্পদ। আর সড়কে এলোপাতাড়ি করে রাখা রোড ডিভাইডার সরাতে গিয়ে পুলিশ সময়মত পৌঁছুতে পারেনি, তাণ্ডবকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে নি।

২০১২ সালের ১৮ নভেম্বর নগরীর দু’নম্বর গেট এলাকায় দৈনিক পূর্বকোণ অফিস, জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনের সড়কসহ আশাপাশের এলাকায় ঝটিকা মিছিল বের করে পুলিশের উপর হামলাসহ ব্যাপক তাণ্ডব সৃষ্টি করে জামায়াত-শিবির। ওইদিন পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে প্রায় আধা কিলোমিটার সড়ক জুড়ে থাকা বিএসআরএম’র রোড ডিভাইডারগুলো এলোপাতাড়ি করে রেখে অবরোধ সৃষ্টি করে জামায়াত-শিবির। তারপর নির্বিচারে যানবাহন ভাঙচুর শুরু করে। এসময় জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের নিরাপত্তাকর্মীরা শিবিরকে প্রতিরোধের জন্য এগিয়ে আসতে চাইলে তারা ডিভাইডার ভেঙে তাদের দিকে ছুঁড়তে থাকে বলে তথ্য আছে পুলিশের কাছে।

এরপর ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশের পর নগরীর কাজির দেউড়িতে একই কায়দায় তাণ্ডব সৃষ্টি করে শিবির। এসময় জামায়াত-শিবির ডিভাইডার দিয়ে সড়ক অবরোধের পাশাপাশি সেগুলো ভেঙ্গে ভিআইপি টাওয়ারের বিভিন্ন অভিজাত দোকানের সামনের আয়না ভাঙচুর করে।

এভাবে মাসের পর মাস ধরে জামায়াত-শিবির নগরীতে বেশ কয়েকটি সহিংস ঘটনার জন্ম দিয়েছে।

ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বাংলানিউজকে বলেন,  ‘অস্থায়ী ডিভাইডার হতে পারে দু’চারদিন কিংবা এক মাসের জন্য। সেগুলোকে বছরের পর বছর রেখে দেওয়া মানে তো স্থায়ী রূপ দিয়ে ফেলা। এভাবে অস্থায়ী ডিভাইডার বসিয়ে তো সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না। এগুলো শুধু সমস্যা জিইয়ে রাখে এবং নিত্যনতুন সমস্যার সৃষ্টি করে। ’

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত তত্তাবধায়ক সরকারের আমলে বিএসআরএম কর্তৃপক্ষ ট্রাফিক পুলিশকে সহযোগিতার নামে অস্থায়ী রোড ডিভাইডারের ধারণা দেয়। এসময় নগরীর পূর্ব নাসিরাবাদে কর্ণফুলী ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস (কেইডব্লিউ) নামে বিএসআরএম’র একটি কারখানা চালুর অপেক্ষায় ছিল। ওই কারখানায় প্রায় ৬০ থেকে ৭০ কেজি ওজনের এ ডিভাইডারগুলো তৈরি হয়।

বিএসআরএম তাদের নাম এবং লোগো সম্বলিত ডিভাইডারগুলো পুলিশের চাহিদা অনুযায়ী চট্টগ্রাম নগরীসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ও মোড়ে স্থাপন শুরু করে মূলত তত্তাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালে।

এরপর থেকে পুলিশ কোথাও ডিভাইডার ভেঙ্গে গেলে কিংবা নতুনভাবে ডিভাইডার বসানোর প্রয়োজন হলে বিএসআরএম কর্তৃপক্ষকে চাহিদাপত্র দেয়, আর তারা সে অনুযায়ী সরবরাহ করে।

সূত্রমতে, বিনামূল্যে ট্রাফিক পুলিশকে এসব ডিভাইডার সরবরাহ করলেও প্রচারণাই ছিল বিএসআরএম’র মূল উদ্দেশ্য। এ ডিভাইডারগুলো খুবই নিম্নমানের যা সহজেই ভেঙে ফেলা যায়। আর এর ভাঙা অংশই সহিংসতায় ব্যবহার করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ডিভাইডারগুলো ওজনে আরও ভারি হওয়ার কথা থাকলেও বিএসআরএম কর্তৃপক্ষ সে মান রক্ষা করে তৈরি করেনি। তাই ওজনে হালকা এসব ডিভাইডার সহিংসতা সৃষ্টিকারীরা তাদের মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে সহজেই ব্যবহার করছে।

এদিকে বিএসআরএম কর্তৃপক্ষ ডিভাইডার স্থাপনের নামে নগরজুড়ে প্রচারণার এক অভাবনীয় কৌশল শুরু করে যাতে তারা ব্যাপক সাফল্য পায়। আর ডিভাইডারগুলো সরবরাহের মাধ্যমে বিএসআরএম কর্তৃপক্ষ তাদের কারখানাটিও ব্যাপকভাবে চালু করে ফেলে।

অভিযোগ আছে, নগর পুলিশের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নিয়মিত উপহার আর অনুদান দিয়ে পুলিশকে খুশি রেখে বিএসআরএম নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে প্রচারণা। এছাড়া পুলিশের কাছ থেকে আদায় করে নিচ্ছে বিভিন্ন অবৈধ সুবিধাও।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বিএসআরএম’র ডাকে সাড়া দিয়ে পুলিশ যখন চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন সড়কে অস্থায়ী ডিভাইডারগুলো স্থাপন করা হচ্ছিল তখনই বিভিন্ন মহল থেকে আপত্তি উঠেছিল। তখন অনেকেই আশংকা করেছিলেন, ডিভাইডারগুলো রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় কিংবা দুর্যোগের সময় প্রতিবন্ধক হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

কিন্তু পুলিশসহ বিভিন্ন মহলের দাবি, আপত্তি অগ্রাহ্য করে বিএসআরএম’র ডাকে সাড়া দেয় পুলিশ। এরপরই মূলত নগরীর ব্যস্ততম ও গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সড়কে ডিভাইডারগুলো বসিয়ে দে য়া হয়।

বিএসআরএমকে নিয়ে পুলিশের অতিরিক্ত আগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, সিএমপি’র বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিএসআরএম কর্তৃপক্ষ আর্থিক সহযোগিতা দেয়। এছাড়া নগর পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ে যারাই আসেন তাদের সঙ্গেই গভীর সখ্য গড়ে তোলেন বিএসআরএম’র কর্মকর্তারা।

নগরীতে নতুন সৃষ্ট চার থানার মধ্যে সদরঘাট থানা ভবন নির্মাণে বড় সহযোগিতা দিয়েছে  বিএসআরএম। এভাবে উপঢৌকন আর অনুদান দিয়ে পুলিশকে খুশি রেখেই বিএসআরএম তাদের কাজ হাসিল করে নিচ্ছে।

সূত্রমতে, শুধুমাত্র ডিভাইডার বসিয়ে প্রচারণা নয়, পুলিশ কর্মকর্তাদের খুশি রেখে আরও অনেক সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে বিএসআরএম। দিনের বেলায় নগরীতে ট্রাক চলাচলের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ থাকলেও বিএসআরএম’র ক্ষেত্রে সে নিষেধ প্রয়োগ করছেনা পুলিশ। বিএসআরএম তাদের রড, লোহার পাতবোঝাই ট্রাক দিব্যি দিনের বেলায় পরিবহন করে থাকে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫০ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।