চট্টগ্রাম: কলকাতার একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের সঙ্গে চট্টগ্রামের একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের আলাপচারিতা চলছে। একথা সেকথার পর অনিবার্যভাবে এলো মাস্টারদা সূর্য সেনের কথা।
সর্বশেষ ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি তৎকালীন চসিক মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলমের সভাপতিত্বে করপোরেশনের ৫৫তম সাধারণ সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল লালদীঘি পাড়ের চত্বরটির নামকরণ করা হবে ‘সূর্য সেন স্কয়ার’। প্রায় এক বছর গত হলেও চসিক ওই চত্বরের নকশা, স্থাপনা নির্মাণ বা উদ্বোধনের মতো কিছুই করতে পারেনি।
১২ জানুয়ারি। মাস্টারদা সূর্য সেনের ফাঁসি দিবস। ১৯৩৪ সালের এদিনে চট্টগ্রাম কারাগারে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এ মহানায়ককে ফাঁসি দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার।
নাট্যজন প্রদীপ দেওয়ানজী এ প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে বলেন, চট্টগ্রাম শুধু নয় বাংলাদেশেই সূর্য সেন অবহেলিত। অবহেলা-অনাদরে বেদখল হচ্ছে রাউজানের সূর্য সেন পল্লি, ভিটেমাটি। চট্টগ্রামে সবেধন নীলমণি জেএম সেন হলে একটি আবক্ষমূর্তি আছে। অথচ ভারতে সূর্য সেনকে নিয়ে বিশাল বাজেটের ‘খেলে হাম জি জান সে’সহ দুটি চলচ্চিত্র হয়েছে। অগণিত নাটক হয়েছে। তার স্মৃতিরক্ষায় নানান উদ্যোগ রয়েছে।
বাংলাদেশে শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’টি ছাত্রাবাসের নামকরণ হয়েছে। এর বাইরে কারাগারে ফাঁসির মঞ্চটি সংরক্ষণ করা হয়েছে মাত্র।
অবিলম্বে নগরীর একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও মিলনায়তনকে সূর্য সেনের নামে নামকরণের দাবি জানিয়ে এ নাট্যজন বলেন, এই তো সেদিন চট্টগ্রামের মাটিতেই জামায়াত ‘ডাকাত’ আখ্যা দিয়েছিল সূর্য সেনকে। কত বড় স্পর্ধা তাদের। এর জন্য দায়ী আমরা।
নতুন প্রজন্মকে সূর্য সেন সম্পর্কে জানানোর, তার স্মৃতি জাগরূক রাখার মতো স্থায়ী কিছুই তো তাদের সামনে রাখতে পারিনি। শুধু বক্তৃতায় সূর্য সেন-প্রীতিলতা বলে গলাবাজি হয়, কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। সূর্য সেন নিয়ে চট্টগ্রামে তিনটি মঞ্চ নাটক হয়েছে। আমি আরেকটি লিখছি। একমাত্র নাটকেই বেঁচে আছেন সূর্য সেন।
ফাঁসি দিবসকে ঘিরে মঙ্গলবার সকালে নগরীর রহমতগঞ্জের জে এম সেন হলে মাস্টারদার আবক্ষ মূর্তিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয় বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে।
বিকেল চারটায় চট্টগ্রাম নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদের উদ্যোগে স্মরণসভা হবে নগরীর নিউমার্কেট দোস্ত বিল্ডিংয়ের দোতলায় মুক্তিযোদ্ধা মিলনায়তনে।
সকালে জেএম সেন হলে আবক্ষ মূর্তিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করতে আসা বিধান সেন বাংলানিউজকে বলেন, মাস্টারদা সূর্য সেনের স্মৃতিরক্ষায় ১৯৭৫ সালের ১৮ এপ্রিল ‘বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রাম স্মৃতি সংস্থা ও সূর্য সেন স্মারক প্রতিমূর্তি কমিটি কলকাতা’ জেএম সেন হলে স্থাপন করেছিল আবক্ষ মূর্তিটি। এত বড় একজন বীরকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি, এখনো হচ্ছে না।
ফাঁসি দিবসে সূর্য সেন স্মরিত হচ্ছেন ভার্চুয়াল জগতে, জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। মাস্টারদা সূর্য সেনকে লাল সালাম জানিয়ে রাজেকুজ্জামান রতন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছিল। তার অপরাধ, তিনি ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করে চট্টগ্রামে স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করেছিলেন ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল।
‘তোমাদের জন্যে আমি কি রেখে গেলাম? একটি স্বপ্ন, একটি সোনালি স্বপ্ন। ’ মৃত্যুর আগে লিখে যাওয়া শেষ চিঠিতে স্বপ্ন ও কর্তব্যের কথা লিখে গিয়েছিলেন তিনি।
লিখেছিলেন, ‘যদি লক্ষ্যে পৌঁছাবার পূর্বে মৃত্যুর শীতল হাত তোমাকে স্পর্শ করে তবে তোমার দায়িত্ব তোমার পরবর্তীদের হাতে দিয়ে যেও। যেমন আমি গেলাম। এগিয়ে চল, কমরেড! এগিয়ে চল। কখনো পিছিয়ে পড়োনা!’ এ স্বপ্নদ্রষ্টাকে ব্রিটিশরা শুধু ফাঁসি দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তার মৃতদেহ গভীর সমুদ্রে ফেলে দিয়ে এসেছিল।
আজ স্বপ্ন ধ্বংসের এই কালে আমরা গভীর বেদনা ও প্রতীজ্ঞায় তোমাকে স্মরণ করি। বেদনা এ কারণে যে, তোমার স্বপ্ন এখনও অপূর্ণ। আর প্রতিজ্ঞা করছি যে, মুক্তির স্বপ্ন ধারণ করে লড়াই আমরা অব্যাহত রাখবো। ’’
নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘...শেষ দিনগুলোতে ফেরারি সশস্ত্র বিপ্লবী জীবনযাপনকালে ব্রিটিশ প্রশাসনের হাতে গ্রেফতার হয়ে নির্মম নির্যাতনের শিকার হন ও ফাঁসির কাষ্ঠে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে ব্রিটিশরা হাতুড়ি দিয়ে তাঁর দাঁত হাড় ভেঙে দেয়। হাতুড়ি দিয়ে নির্মম ভাবে পিটিয়ে অত্যাচার করা হয়। এরপর তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। পরবর্তীতে তাঁকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। সেদিন সূর্য সেনের লাশ আত্মীয়দের হাতে হস্তান্তর করা হয়নি এবং হিন্দু সংস্কার অনুযায়ী পোড়ানো হয়নি।
ফাঁসির পর লাশ জেলখানা থেকে ট্রাকে করে নদীর ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর মৃতদেহ ব্রিটিশ ক্রুজারে তুলে নিয়ে বুকে লোহার টুকরা বেঁধে বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরের সংলগ্ন একটা জায়গায় ফেলে দেওয়া হয়। ’
সূর্য সেনের জন্ম ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ। চট্টগ্রামের রাউজানের নোয়াপাড়া গ্রামে। বাবা রাজমণি সেন। মা শশী বালা সেন। দুই ভাই চার বোনের মধ্যে সূর্য ছিলেন চতুর্থ। তার পুরো নাম সূর্যকুমার সেন। ডাকনাম ছিল কালু। সবচেয়ে বেশি পরিচিত মাস্টারদা নামে। শৈশবে বাবা-মা হারানো সূর্য মানুষ হয়েছিলেন কাকা গৌরমণি সেনের কাছে।
তারপরের ইতিহাস গৌরবের, ত্যাগের। যা লেখা আছে সোনার হরফে। যা আছে বাঙালির হৃদয়ে, চেতনায়।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৫
এআর/আইএসএ/টিসি