সিটিটিসি’র কর্মকর্তারা মনে করছেন, নব্য জেএমবির দুই সদস্যকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে হামলার পরিকল্পনা ভন্ডুলের পাশাপাশি বড় ধরনের নাশকতা থেকে চট্টগ্রামকে রক্ষা করা গেছে।
অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া সিটিটিসি’র অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) এ এ এম হুমায়ুন কবির বাংলানিউজকে বলেন, ১৩-১৪ বছর বয়সী কিশোর নাফিসের নিখোঁজের ঘটনায় চকবাজার থানায় একটি জিডি হয়।
‘সদরঘাটে নাফিসের অবস্থানের বিষয়টি গভীরভাবে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জঙ্গি আস্তানাটির সন্ধান পেয়েছি। নাফিসও বর্তমানে নব্য জেএমবির সঙ্গেই আছে। তাকে এখনো পাওয়া যায়নি। ’ বলেন এডিসি হুমায়ুন
চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূরুল হুদা বাংলানিউজকে বলেন, নাফিস নগরীর কাজেম আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। গত ৬ অক্টোবর স্কুলে গিয়ে নিখোঁজ হয়। এই ঘটনায় তার বাবা নজরুল ইসলাম চকবাজার থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি করেন। ৭ অক্টোবর করা এই জিডির নম্বর ৩২১।
প্রায় এক মাস ধরে অবস্থান রেকি করার পর সোমবার (০১ জানুয়ারি) পূর্ব মাদারবাড়ির বালুর মাঠ সংলগ্ন পোর্ট সিটি হাউজিং সোসাইটির মিনু ভবনের পঞ্চম তলায় অভিযান চালানো হয়। এসময় সেখান থেকে দুজনকে গ্রেফতারের পাশাপাশি সদরঘাট থানায় হামলার পরিকল্পনা-সম্বলিত টার্গেট ওয়ান লেখা একটি মানচিত্র পাওয়া গেছে। এছাড়া ১০টি তাজা হ্যান্ড গ্রেনেড, ২টি সুইসাইডাল ভেস্ট এবং একটি মোবাইল ও একটি ট্যাব উদ্ধার করা হয়।
গ্রেফতার হওয়া নব্য জেএমবির দুই সদস্য হলেন, ময়মনসিংহের মো.আশফাকুর রহমান ওরফে আবু মাহির আল বাঙালি ওরফে রাসেল ওরফে সেলেবি তিতুশ (২২) এবং কুমিল্লার মো.রাকিবুল হাসান ওরফে জনি ওরফে সালেহ উদ্দিন আয়ূবী ওরফে আবু তাইছির আল বাঙালি ওরফে হাসান (১৯)।
আটকের পর তাদের বিরুদ্ধে সিটিটিসি’র পরিদর্শক রাজেশ বড়ুয়া বাদি হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সদরঘাট থানায় একটি মামলা দাযের করেছেন।
টায়ার ব্যবসায়ী পরিচয়ে বাসা ভাড়া নেয়
টায়ার ব্যবসায়ী পরিচয়ে গত অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে মিসবাহ নামে একজন এসে মিনু ভবনের মালিক পরিবহন ব্যবসায়ী ইব্রাহিম মান্নান মিনুর কাছ থেকে ব্যাচেলর বাসাটি ভাড়া নেন। ইব্রাহিম বাংলানিউজকে জানান, আমি ঘর ভাড়া দেওয়ার নোটিশ ঝুলিয়েছিলাম। সেটা দেখে মিসবাহ প্রথমে ফোনে এবং সরাসরি এসে যোগাযোগ করে। সে বলেছিল ঢাকা থেকে টায়ার এনে মিসবাহ চট্টগ্রামে সাপ্লাই দেয়। সে নিজে বাসায় থাকবে না। তার ম্যানেজার থাকবে। পরে দেখি সেখানে দুজন থাকছে।
দুই মাসেরও বেশি সময় অবস্থানের মধ্যে দুজনকে মাত্র ৫-৭ বার দেখেছেন জানিয়ে ইব্রাহিম বাংলানিউজকে বলেন, তাদের বাসা অধিকাংশ সময় তালাবদ্ধ ছিল। একবার আমি একটি চার্জলাইট খোঁজার জন্য তাদের বাসায় গিয়েছিলাম। তারা দরজা পুরো না খুলেই চার্জলাইটটি আমাকে দেয়। তাদের আচরণ খুবই ভদ্র ছিল। মিসবাহর আচরণও ভদ্র ছিল।
নারী ওসি, তাই টার্গেট সদরঘাট থানা !
নব্য জেএমবির আস্তানা থেকে হাতে আঁকা তিনটি মানচিত্র উদ্ধার করেছে সিটিটিসি। এসব মানচিত্র আঁকা হয়েছে সদরঘাট থানাকে কেন্দ্র করেই।
মামলার বাদি সিটিটিসি’র পরিদর্শক রাজেশ বড়ুয়া বাংলানিউজকে বলেন, হাতে আঁকা মানচিত্রগুলো বিশ্লেষণ করে আমরা যেটা পেয়েছি, সদরঘাট থানার দিকে যাবার যে কয়টি পথ আছে সেখানে সবগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। আবার কোন কোন পথ জনবহুল সেটার নির্দেশনাও আছে। সদরঘাট থানা কম্পাউন্ডের ভেতরে কি কি স্থাপনা আছে সেটাও চিহ্নিত করা হয়েছে।
‘আশফাকুর এবং রাকিবুলের নাম দুটি মানচিত্রে দুইবার লেখা আছে। মানচিত্র বিশ্লেষণ করে মনে হচ্ছে, তারা হামলার পরিকল্পনা প্রায় গুছিয়ে এনেছিল। জিজ্ঞাসাবাদেও তারা এই বিষয়ে কিছু তথ্য দিয়েছে। ’ বলেন রাজেশ বড়ুয়া
নগরীর পশ্চিম মাদারবাড়ি ডি টি রোডে সিএমপির ট্রাফিক বিভাগের কার্যালয়ের ভেতরে সদরঘাট থানার অবস্থান।
সদরঘাট থানা টার্গেট কেন, জানতে চাইলে সিটিটিসি’র অতিরিক্ত উপ-কমিশনার এএএম হুমায়ুন কবির বাংলানিউজকে বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে যতটুকু জেনেছি, প্রথম বিষয়টি হচ্ছে সদরঘাট থানার ওসি একজন নারী। জঙ্গিরা ওসি’র মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে একজন নারীকে দেখতে চায় না। সদরঘাট থানা কম্পাউন্ডে সবার অবাধ যাতায়াত আছে। এই সুযোগটাই জঙ্গিরা নিতে চেয়েছিল।
জানতে চাইলে সদরঘাট থানার ওসি মর্জিনা আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, নারী ওসি হওয়ায় সদরঘাট থানা টার্গেট বলে যেটা বলা হচ্ছে সেটা সঠিক বলে আমার মনে হচ্ছে না। কারণ এখন নারীরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। তাহলে কি নারী যেসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান, এর সবগুলোতেই হামলা হবে ?
‘মূল বিষয় হচ্ছে, সদরঘাট থানার ভেতরে যে কেউ সহজেই ঢুকে যেতে পারে। কারণ এখানে গাড়ির মামলা নিয়ে ট্রাফিক অফিসে প্রতিদিন শত, শত সাধারণ মানুষ আসে। ক্যান্টিন আছে থানা কম্পাউন্ডের ভেতরে। বি-ক্যাশ এবং মোবাইল রিচার্জ করার দোকানও আছে। এছাড়া যে মসজিদ আছে সেখানে নামাজের সময় যে কেউ আসতে পারেন। সব মিলিয়ে সদরঘাট থানায় হামলার মতো সুবিধা আর কোথাও নেই। ’ বলেন ওসি মর্জিনা আক্তার
জঙ্গিদের যোগাযোগের জন্য বিশেষ অ্যাপস
নব্য জেএমবির দুই সদস্যকে আটকের পর তাদের যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত একটি বিশেষ অ্যাপসের সন্ধান পেয়েছে সিটিটিসি। তবে অ্যাপসটির নাম জানাতে রাজি হননি সিটিটিসি’র কর্মকর্তারা। অ্যাপসটিতে বিভিন্ন ছদ্মনামে জঙ্গিরা পরস্পরের সঙ্গে আলাপ করতেন।
জানতে চাইলে এডিসি এ এ এম হুমায়ুন কবির বাংলানিউজকে বলেন, গ্রেফতার হওয়া দুই জঙ্গি যে গ্রুপের সঙ্গে জড়িত তারা মূলত মোবাইলে বা ফেসবুকে সরাসরি কথা বলে না। বিশেষ অ্যাপসের মাধ্যমেই যোগাযোগ করে। আবু আনাস আল বাঙাল, নদীর মাছ, সংসদ সদস্য, হোয়াইট হাউজ এই ধরনের বিভিন্ন নাম তারা ব্যবহার করে।
মামলার বাদি পুলিশ পরিদর্শক রাজেশ বড়ুয়া বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে দুজন জানিয়েছেন, ডন নামে একজন তাদের পুলিশের স্থাপনায় নাশকতা করার জন্য চট্টগ্রামে পাঠিয়েছিলেন। ডনকে নব্য জেএমবির সদস্যরা আত্মঘাতী হামলাকারী গ্রুপের আমির বলে উল্লেখ করেছেন।
তবে বাসা ভাড়া নেওয়া মিসবাহ এবং ডন একই ব্যক্তি নন বলে জানিয়েছেন পরিদর্শক রাজেশ বড়ুয়া।
এডিসি হুমায়ুন কবির বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, নব্য জেএমবির দুই সদস্যদের কাছ থেকে জীবন ইসলাম নামে একজনের নামও পাওয়া গেছে। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে ডন, মিসবাহ এবং জীবনের নেটওয়ার্কের বিষয়ে তথ্য পাবার চেষ্টা করব।
নব্য জেএমবির ২ জন আটক, থানায় হামলার পরিকল্পনা ভণ্ডুল
বাংলাদেশ সময়: ২০৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০২, ২০১৮
আরডিজি/টিসি