এমন পরিস্থিতিতে তার স্কুল পটিয়ার উত্তর গোবিন্দারখীল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও ঝুঁকি নিতে নারাজ। কারণ পরীক্ষা দিলে নিশ্চিত ফেল-প্রশ্নই যে দেখতে পাবে না, সে উত্তরপত্রে লিখবেই বা কী? একজন ফেল করা মানে শতকরা পাসের হারে পিছিয়ে পড়া !
কিন্তু পরীক্ষা দিতে পারবেনা শুনেই কান্নায় ভেঙে পড়ে ফাহিম।
শত বাধা ডিঙ্গিয়ে পরীক্ষা দেওয়া মোহাম্মদ ফাহিম জিপিএ-৫ পেয়ে পিইসিতে উত্তীর্ণ হয়েছে।
তাই কষ্টের দিনগুলো ফাহিমের কাছে এখন যেন অতীত। সেই কান্নার মুখজুড়ে এখন কেবল হাসির রেখা। একটা জিপিএ-৫ নামক উজ্জ্বলতার ছটায় যেন ম্লান হয়ে গেছে ফাহিমের যাবতীয় কষ্টের রং। প্রথম ধাক্কায় সফল কিশোরের মুখে এখন নতুন যুদ্ধজয়ের প্রস্তুতি-তাকে যে অনেকদূর পাড়ি দিতে হবে!
পটিয়া উপজেলার হাইদগাঁও ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রহমত আলী ও রেহেনা আক্তারের ছেলে মো. ফাহিম। জন্মের পর থেকে ৫ বছর পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকভাবে চলছিল ফাহিমের। কিন্তু এর পর থেকেই চোখে কম দেখতে শুরু করে সে। উত্তর গোবিন্দারখীন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হলে কষ্ট করে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা চালিয়ে যায় সে। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণিতে উঠার পর থেকেই চোখে একেবারেই কম দেখতে পাচ্ছিল সে। এই কম দেখা নিয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কোনরকম পাস করে ফাহিম। কিন্তু দেখা যায় লেখার সময় সারিগুলো সোজাসুজি তো দূরের কথা-এদিক-ওদিক চলে যাচ্ছে। পরে তার শিক্ষক মনোয়ারা বেগমের কাছ থেকে খবর পেয়ে উম্মে তাসলিমা চৌধুরী ফাহিমের পাশে দাঁড়ান।
কথা হয় উম্মে তাসলিমা চৌধুরীর সঙ্গে।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘মনোয়ারা বেগম যখন বিষয়টি আমাকে জানালেন তখনি নিজ থেকেই ফাহিমকে সহযোগিতা করার জন্য নেমে পড়ি। কারণ আমি নিজেই শত সংগ্রাম করে এ পর্যায়ে এসেছি। নিজের সেই উপলব্দি থেকেই ফাহিমের পাশে দাঁড়াই। তাকে শহরের একজন চিকিৎসককে দেখানোর পর নিশ্চিত হই-সে ব্লাইন্ড। ’
‘এমন পরিস্থিতিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারাও এক্ষেত্রে সহযোগিতা করেন। পরে পটিয়া মোহছেনা মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী আরনাভ শহিদকে তার শ্রুতিলেখক হিসেবে নির্ধারণ করি। পরে তার সহযোগিতায় ফাহিম পিইসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। সে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে তার অর্জনই আমার প্রাপ্তি। ’-বলে যান উম্মে তাসলিমা চৌধুরী।
ছেলের অর্জনে দারুণ খুশি মা রেহেনা আক্তার ও রহমত আলী।
দুজন বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা ফাহিমের স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফরিদা ম্যাডাম, সহকারী শিক্ষিকা মনোয়ারা ম্যাডামের কাছে। আর বিশেষ করে কৃতজ্ঞ উম্মে তাসলিমা ম্যাডামের সঙ্গে। তিনি ফাহিমের খবর পাওয়ার পর থেকে আমাদের পাশে ছায়ার মতো ছিলেন। আমরা আমাদের ছেলেকে শত কষ্ট হলেও পড়াতে চাই। সবার সহযোগিতা চাই। ’
ছেলের ফলাফলে উচ্ছ্বসিত মা রেহেনা আক্তার বলেন, ‘ছোটকাল থেকেই আমি একজন পুলিশ কর্মকর্তা হতে চাইতাম। কিন্তু এসএসসির পর আর পড়ালেখা করা হয়নি। সমাজ বাস্তবতায় আমারও আর পুলিশ কর্মকর্তা হওয়া হয়নি। ছেলের মধ্যেই তাই সেই স্বপ্ন দেখি। ’
আর ছোট্ট ফাহিম? তার স্বপ্ন অবশ্য মায়ের চেয়ে দুটি বেশিই।
এক-ভালো মানুষ হওয়া।
দুই-পড়ালেখা ভালোভাবে শেষ করা।
আর
একজন পুলিশ কর্মকর্তা হয়ে দেশের সেবা করা।
‘ফাহিম স্বপ্নের সমান বড় হোক’-অদম্য কিশোরের জন্য এই প্রার্থনাতো করাই যাই।
বাংলাদেশ সময়: ২১৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০২, ২০১৭
টিএইচ/টিসি