বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ নাগরিক সঞ্জয় দাশের সাথে বিরোধের জের ধরেই এমন ঘটনার শিকার হয়েছেন তিনি।
কে এই সঞ্জয় দাশ? তার এতো ক্ষমতার উৎস কোথায়? কেনইবা পুলিশ তার ‘নির্দেশ’ পালনে বাধ্য? বাংলানিউজের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে নানা তথ্য।
সঞ্জয় দাশ (৩৬) বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী গ্রামের অসিত দাশের ছেলে। অসিত দাশের তিন ছেলের (সমীরণ দাশ, সৌমেন দাশ ও সঞ্জয় দাশ) সবার ছোট সঞ্জয় দাশ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর অসিত দাশের মা-ভাইয়েরা ভারতে চলে যান এবং অসিত দাশ ও তার বাবা নিরঞ্জন দাশ থেকে যান। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের যেসব নাগরিক ভারত চলে গিয়েছিলেন তাদের সম্পত্তিগুলো ‘শত্রু সম্পত্তি’ (বর্তমানে যা ‘অর্পিত সম্পত্তি’ নামে অভিহিত) হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। পরে অসিত দাশদের পৈত্রিক সম্পত্তিগুলোর কিছু বাদে বাকিগুলো ‘শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। এবং এসব সম্পত্তি পরবর্তীকালে সরকারের কাছ থেকে লিজ নেন তাদের প্রতিবেশী স্বপন দাশ ও তার পরিবার।
১৯৯৭ সালের দিকে অসিত দাশ স্ত্রী ও তিন ছেলেকে নিয়ে বোয়ালখালী থেকে ঢাকায় চলে যান। বোয়ালখালীতে তাদের জায়গা-জমি পরিত্যক্ত হিসেবে থাকে। ২০০১ সালের দিকে অসিত দাশের স্ত্রী মারা যান। ২০০৩ সালের দিকে অসিত দাশ ও তার দুই সন্তান সৌমেন দাশ ও সঞ্জয় দাশ লন্ডনে চলে যান এবং এরপর থেকে তারা সেখানেই বসবাস করে আসছেন। তবে বড় ছেলে সমীরণ দাশ থেকে যান ঢাকায়।
ঘটনার শুরু যেভাবে
২০১৭ সালের এপ্রিলে অসিত দাশের প্রতিবেশী স্বপন দাশ তার লিজ নেওয়া জায়গা থেকে স্থানীয় মন্দিরে একটি গাছ দান করেন। সেই গাছের লাকড়ি বিক্রি করে মন্দির কর্তৃপক্ষ ৭০০ টাকার মতো পান। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ-যুবলীগ পরিচয় দানকারী কিছু ‘গ্রাম্য টাউট’ লন্ডনে অসিত দাশের ছোট ছেলে সঞ্জয় দাশের সাথে যোগযোগ করে। অসিত দাসকে এরা জানায়, তাদের বাপ-দাদার সম্পত্তিগুলো স্বপন দাশ ও তার পরিবার আত্মসাৎ করে ভোগ দখল করে আসছে। এসব সম্পত্তি বিক্রি করলে অনেক টাকা পাওয়া যাবে বলে লোভও দেখায় সঞ্জয় দাশকে।
সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের মে মাসে সঞ্জয় দাশ বাংলাদেশে চলে আসেন। এসেই ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে বাপ-দাদার সম্পত্তিগুলো উদ্ধারে সহযোগিতা চান। পরে মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা (আপস-মীমাংসা) নেওয়ার পুলিশকে অনুরোধ করা হয়। পরে পুলিশের উপস্থিতিতে সঞ্জয় দাশ ও স্বপন দাশের মধ্যে বৈঠকও হয়। সেই বৈঠকে স্বপন দাশকে সম্পত্তিগুলো দ্রুত ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ দেয় পুলিশ। বিন্তু স্বপন দাশ এতে রাজি না হয়ে বিষয়টি আদালতের মাধ্যমে সমাধান হবে বলে জানান।
সূত্রমতে, স্বপন দাশের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে সম্পত্তি দ্রুত ফিরে পেতে সঞ্জয় দাশ পুলিশের সাথে মৌখিক চুক্তি করেন এবং পুলিশকে মোটা অঙ্কের টাকা দেন বলে সঞ্জয় দাশের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। সম্পত্তি দখল নিয়ে দেওয়ার পর আরো টাকা দেবেন বলেও সঞ্জয় দাশ পুলিশকে প্রতিশ্রুতি দেন এমন অভিযোগও রয়েছে।
এরপর স্বপন দাশ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে বেশ কয়েকটি মিথ্যা মামলা করেন সঞ্জয় দাশ। পুলিশও কয়েকটি মামলায় অজ্ঞাত আসামি হিসেবে স্বপন দাশ ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম জুড়ে দেয়। এসব মামলায় স্বপন দাশ জেলেও যান বলে জানায় সূত্র। তিনমাসের অধিক সময় স্বপন দাশ জেল খেটে বের হন বলে অভিযোগ করেন স্বপন দাশের ভাই রূপন দাশ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জেল থেকে বের হওয়ার পর স্বপন দাশ ও তার ছেলেকে জিম্মি করে পুলিশের উপস্থিতিতে জোর করে দলিলে স্বাক্ষর করিয়ে নেন সঞ্জয় দাশ। পরে তাদের ছেড়ে দিয়ে আর বোয়ালখালী ফিরে না যেতে হুমকিও দেন। কিন্তু চাপের মুখে দলিলে স্বাক্ষর করার আগে স্বপন দাশ আবু তাহের নামে একজনের কাছে কিছু সম্পত্তি বিক্রি করেন।
সূত্র জানায়, এসব সম্পত্তি সঞ্জয় দাশের দখলে গেলে আবু তাহের আদালতে মামলা করে। স্বপন দাশের বাড়ি দখল করতে গেলে বাড়ির কেয়ারটেকার শংকর দত্ত মদন বাধা দেয়। এতে শংকর দত্ত মদন ও তার স্ত্রী মঞ্জু দত্তকে পিটিয়ে আহত করে। শংকর দত্ত মদনের স্ত্রী মঞ্জু দত্তকে লাকড়ি চুরি ও হত্যাচেষ্টার দুইটি মামলা দিয়ে জেলে পাঠান সঞ্জয় দাশ।
আরও পড়ুন>>
** আ.লীগ নেতাকে মাদক-অস্ত্র মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ
দুইমাস পর জামিনে বের হলে মঞ্জু দত্তকে আবার পেটায় সঞ্জয় দাশ। তখন ২০১৭ সালের নভেম্বরে আদালতে সঞ্জয় দাশের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলা করেন মঞ্জু দত্ত। এতে আবার ক্ষিপ্ত হয়ে শংকর দত্ত মদনকে জমিতে কৃষিকাজ করার সময় ধরে এনে ৮০ পিস ইয়াবা দিয়ে মামলা দিয়ে জেলে পাঠায়। পরে মঞ্জু দত্তকে চাপ দিয়ে মামলা প্রত্যাহারে বাধ্য করে সঞ্জয় দাশ।
সমরকৃষ্ণ চৌধুরীকে যে কারণে জড়ানো হয়
স্বপন দাশের বাল্যবন্ধু আওয়ামী লীগ নেতা সমরকৃষ্ণ চৌধুরী। আইনজীবীর সহকারী হিসেবে চট্টগ্রাম জজকোর্টে কাজ করেন। স্বপন দাশ যখন সম্পত্তি নিয়ে বিপদে পড়েন তখন তার পাশে দাঁড়ান সমর চৌধুরী।
স্বপন দাশের কাছ থেকে জমি ক্রেতা তাহের মিয়া আদালতে মামলা করেন। তখন সঞ্জয় দাশ ইন্ধনদাতা হিসেবে সমর চৌধুরীকে সন্দেহ করেন। গত বছরের নভেম্বরে সমর চৌধুরীর চট্টগ্রাম মহানগরের নন্দনকাননের বাসায় গিয়ে এ বিষয়ে কথা না বলতে হুমকিও দিয়ে আসেন বলে অভিযোগ করেছেন সমর চৌধুরীর পরিবারের লোকজন। পরে সমর চৌধুরীকে ইয়াবার মামলায় জড়িয়ে দেন তিনি।
সর্বশেষ গত রোববার (২৭ মে) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে চট্টগ্রাম নগরের জহুর হকার্স মার্কেটের সামনে থেকে সমর চৌধুরীকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। পরদিন সোমবার (২৮ মে) সকালে ৩১০ পিস ইয়াবা ও একটি একনলা বন্দুক হাতে ধরিয়ে দিয়ে ছবি তুলে সেই ছবি গণমাধ্যামে পাঠায় বোয়ালখালী থানাপুলিশ। ইয়াবা ও অস্ত্র উদ্ধারের মামলা দিয়ে জেলে পাঠায় সমর চৌধুরীকে।
মঙ্গলবার (২৯ মে) বিকেলে সমর চৌধুরীর বড় মেয়ে অলকানন্দ চৌধুরী বোয়ালখালীতে এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের বিরুদ্ধে তার বাবাকে মাদক ও অস্ত্র দিয়ে মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ করেন।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, গত রোববার (২৭ মে) জহুর হকার্স মার্কেটের সামনে থেকে তার বাবাকে সাদা পোশাকধারীরা তুলে নিয়ে যায়। রাতভর বোয়ালখালী থানায় আটকে রাখে। পরদিন সমরকৃষ্ণ চৌধুরীকে তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে অস্ত্র ও ইয়াবাসহ ছবি তোলে। পরে অস্ত্র উদ্ধার ও মাদক মামলা দিয়ে আদালতে চালান দেয়।
অলকানন্দা চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন, বাবাকে আটকের পর আমরা বিভিন্ন জায়গায় তার খোঁজ করেছি। পরে বোয়ালখালী থানায় গেলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিমাংশু কুমার দাস বারবার আমার বাবাকে গ্রেফতারে ‘উপরের নির্দেশ’ রয়েছে বলে জানান।
কার নির্দেশ! কেন নিরীহ ব্যক্তিকে এভাবে মামলা দিয়ে হয়রানি করছেন জানতে চাইলে, ওসি এর কোনো সদুত্তর দেননি।
অলকানন্দা চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক সঞ্জয় দাশের সাথে তার বাবার বন্ধু স্বপন দাশের সাথে জায়গা-সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধ চলছে। এ নিয়ে স্বপন দাশ আমার বাবার (সমরকৃষ্ণ চৌধুরী) সহায়তা চাইলে তিনি একজন ভালো আইনজীবী দেখিয়ে দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সঞ্জয় দাশ পুলিশকে দিয়ে আমার বাবাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। এর আগেও তিনি বাবার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা দিয়েছেন।
বোয়ালখালী উপজেলা পরিষদের সামনে সমর চৌধুরীর মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন করেন তার পরিবারের সদস্যরা। মানববন্ধনে পুলিশ বাধা দেয় বলে অভিযোগ করেন অলকানন্দা চৌধুরী। মানববন্ধনে অংশ নেয়ায় দুইজনকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় বলেও অভিযোগ করেন তিনি। পরে সেই দুইজনকে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
অভিযোগ অস্বীকার করে বোয়ালখালী থানার ওসি হিমাংশু কুমার দাস বাংলানিউজকে বলেন, আগের একটি মামলায় পলাতক আসামি হিসেবে সমর চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরে তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী তার বাড়ি থেকে অস্ত্র ও ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে।
সমর চৌধুরী কোনো মামলায় পলাতক ছিলেন তা জানতে চাইলে ওসি হিমাংশু কুমার দাস কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। ৫ মিনিট পর জানাবেন বলে টেলিফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন ওসি। পরে কল দিলেও টেলিফোনকল আর রিসিভ করেননি ওসি।
অভিযোগের বিষয়ে যা বললেন সঞ্জয় দাশ
সমরকৃষ্ণ চৌধুরী নামে কাউকে চেনেন না, কখনও দেখেনওনি বলে দাবি করে সঞ্জয় দাশ বাংলানিউজকে বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার প্রশ্নই তো আসে না। আমি তো তাকে চিনিও না। ’ তিনি বলেন, ‘সমর চৌধুরীকে হুমকিও দিইনি কখনও। ’
স্বপন দাশের সাথে সম্পত্তির বিরোধের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের পারিবারিক বিষয়। আমরা বসে সমাধান করেছি। স্বপন দাশ আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন, আমিও মামলা করেছি। সেসব আবার আমরা সমাধানও করেছি। ’
তিনি স্বপন দাশের বাড়ির কেয়ারটেকারের স্ত্রী মঞ্জু দত্তের নামের চুরি ও হত্যাচেষ্টার মামলা করেছিলেন বলে স্বীকার করেন।
মঞ্জু দত্ত তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলা করলেও তা পরে ‘প্রত্যাহার’ করে নেন বলে দাবি করেন তিনি।
আবু তাহের নামে একজন তার বিরুদ্ধে আদালতে জমি নিয়ে মামলা করলেও তা প্রতাহ্যার করে নেন বলে দাবি করেন সঞ্জয় দাশ।
অসহায়ত্ব প্রকাশ স্থানীয় জনপ্রতিনিধির
সারোয়াতলী ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের সদস্য সুরেশ চৌধুরী সমরকৃষ্ণ চৌধুরীর গ্রেফতারের ঘটনায় প্রকাশ করলেন বিস্ময় ও নিজের অসহায়ত্ব।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, সমরকৃষ্ণ চৌধুরী পূজা-পার্বণ ছাড়া গ্রামের বাড়িতেই আসেনই না তেমন। অত্যন্ত ভালো মানুষ তিনি। অথচ তাকেই কি না ইয়াবা-অস্ত্র দিয়ে ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হল!
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “আমি এলাকার মেম্বার হিসেবে থেকেও নেই। আমি অসহায়। এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় আমাকেও ইয়াবা দিয়ে মামলা দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার (২৯ মে) সমরকৃষ্ণ চৌধুরীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার প্রতিবাদে মানববন্ধনে অংশ নেওয়ায় আমার বাড়িতে এসে হুমকি দিয়ে গেছে পুলিশ। এসব কিছুই লন্ডনপ্রবাসী সঞ্জয় দাশ করাচ্ছেন পুলিশকে দিয়ে। ”
সুরেশ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, “স্বপন দাশ ও তার পরিবারকে এলাকাছাড়া করেছেন সঞ্জয় দাশ। জোর করে লিখে নিয়েছেন তাদের সম্পত্তিগুলো। শুধু সম্পত্তি দখল করতে গিয়ে কতগুলো মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছেন সঞ্জয় তার হিসেব নেই। ’’
“সঞ্জয় দাশ স্বপন দাশের বাড়ির কেয়ারটেকার শংকর দত্ত মদন ও তার স্ত্রী মঞ্জু দত্তকে পিটিয়ে আহত করেন। পরে তাদের শংকর দত্ত মদনের নামে ইয়াবার মামলা ও তার স্ত্রীর নামে লাকড়ি চুরি ও হত্যাচেষ্টার মামলা দেন। সঞ্জয় দাশের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের একটি মামলা করেন মঞ্জু দত্ত। পরে সেই মামলা প্রত্যাহারে বাধ্য করেন মঞ্জু দত্তকে”-- অভিযোগ করেন সুরেশ চৌধুরী।
বাংলাদেশ সময়: ২০০৫ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১৮
এসকে/টিসি/জেএম