ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এভাবে দর্শনার্থীদের আবদার মেটাচ্ছে নগরের বায়েজিদ বোস্তামী মাজার সংলগ্ন দিঘীতে থাকা কচ্ছপগুলো।
চট্টগ্রাম: বাঁশের চিকন কঞ্চির মাথায় কেউ ছোট পাউরুটির টুকরো, আবার কেউ কলা বা কাঁচা মাংস হাতে আকুল স্বরে ‘বাবা’ সম্বোধন করে ডাকছে। মানুষের আহ্বানে সাড়া দিয়ে পানির ওপর মাথা তুলছে তারা, গ্রহণ করছে খাবারও।
ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এভাবে দর্শনার্থীদের আবদার মেটাচ্ছে নগরের বায়েজিদ বোস্তামী মাজার সংলগ্ন দিঘীতে থাকা কচ্ছপগুলো।
দেশি-বিদেশি পর্যটকরা চট্টগ্রামে এলেই দেখে যান বড় বড় কচ্ছপগুলোকে। ডাক শুনেই মাথা উঁচু করে একসঙ্গে ছুটে আসে গোটা বিশেক কচ্ছপ। খাবার খাইয়ে দিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়, সালামও জানায় মাজারে আসা ভক্তরা। কচ্ছপগুলোর পেট ভরে গেলে হেলেদুলে পানিতে ডুব দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। এ দৃশ্য দেখতে ভীড় জমায় শিশুরাও।
বায়েজিদ বোস্তামীর বিশেষ প্রজাতির কচ্ছপগুলো এখন বিলুপ্তপ্রায়। বিশ্বের কোথাও এই জাতের কচ্ছপের সন্ধান মিলে না। ২০০৪ সালে দিঘীতে বিষ ঢেলে এদের নির্বংশ করার চেষ্টা করেছিল দুর্বৃত্তরা। তবে জাতীয় বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের পদক্ষেপে সে যাত্রায় রক্ষা পায় অনেকগুলো কচ্ছপ।
জানা গেছে, এখানে প্রজনন মৌসুমে মাজারের মূল পাহাড়ের পেছনে সংরক্ষিত স্থানে কচ্ছপগুলোর ডিম পাড়ার ব্যবস্থা করা হয়। যদিও দিঘীর পানিতে প্লাস্টিক ও কাগজের প্যাকেটসহ আবর্জনা ফেলে পানি দূষিত করছে দর্শনার্থীরা। কিছু কচ্ছপের গায়েও দেখা গেছে হালকা ক্ষতচিহ্ন।
ধারণা করা হয়, সূফী সাধক ও আউলিয়ারা চট্টগ্রামে ইসলাম ধর্ম প্রচারের সময় সচরাচর পাহাড়ের ওপর কিংবা জঙ্গলে ঘেরা অঞ্চলে আবাস স্থাপন করেন এবং এসব জায়গায় মাজার প্রতিষ্ঠা করেন। বায়েজিদ বোস্তামীর মাজারও নাসিরাবাদের একটি পাহাড়ে এমন নৈসর্গিক পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত।
ইতিহাস মতে, ইরানের বিখ্যাত পার্সিয়ান সুফি বায়েজিদ বোস্তামীর নামে গড়ে ওঠা এই মাজারে অবয়ব সর্বপ্রথম ১৮৩১ সালে পাহাড়ের উপরিভাগে একটি দেয়ালঘেরা আঙ্গিনার মাঝে আবিস্কার করা হয়। আঙ্গিনার ঠিক মাঝামাঝি একটি শবাধার অবস্থিত। পরবর্তীতে সমাধিস্থলটি আধুনিক কাঠামো দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। সমাধি পাহাড়ের পাদদেশে একটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মোঘল রীতির আয়তাকার মসজিদ ও পাশে বিশালাকার দীঘির অবস্থান। স্থাপত্যশৈলী থেকে ধারণা করা হয় মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব এর আমলে মসজিদটি নির্মিত। জনশ্রূতি অনুযায়ী, বায়েজিদ বোস্তামীর চট্টগ্রামে অবস্থানের পর প্রস্থানকালে ভক্তকূল তাঁকে থেকে যাওয়ার অনুরোধ করলে তিনি তাদের ভালোবাসা ও ভক্তিতে মুগ্ধ হয়ে কনিষ্ঠ আঙ্গুল কেটে কয়েক ফোঁটা রক্ত মাটিতে পড়ে যেতে দেন এবং ওই স্থানে তাঁর নামে মাজার গড়ে তুলবার কথা বলে যান।
এই জনশ্রুতির স্বপক্ষে অষ্টাদশ শতাব্দীর চট্টগ্রামের কিছু কবির কবিতায় শাহ সুলতান নামক একজন মনীষির নাম বর্ণিত আছে। বায়েজিদ বোস্তামীকে যেহেতু সুলতান উল আরেফীন হিসাবে আখ্যায়িত করা হয় সেই সূত্রে এই শাহ সুলতান আর সুলতান উল আরেফীনকে একই ব্যক্তি হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।
আঞ্চলিক জনশ্রুতি অনুযায়ী, মাজার প্রতিষ্ঠাকালে এই অঞ্চলে দুষ্ট জ্বীন এবং পাপিষ্ঠ আত্মার পদচারণা ছিলো। বায়েজিদ বোস্তামী এই অঞ্চলে ভ্রমণকালে এসব দুষ্ট আত্মাকে শাস্তিস্বরূপ কচ্ছপে পরিণত করেন এবং আজীবন পুকুরে বসবাসের দণ্ডাদেশ দেন।
প্রাণিবিজ্ঞানী এন এনানডেলের গবেষণা মতে, বোস্তামীর কচ্ছপ একসময় ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকা থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত বিশাল এলাকাজুড়ে বিচরণ করতো। এই প্রজাতির কচ্ছপ এতই দুর্লভ যে, বর্তমানে শুধু বায়েজিদ বোস্তামী মাজার সংলগ্ন দিঘীতেই এটি টিকে আছে। পৃথিবীর কোথাও এই কচ্ছপ আর দেখা যায় না।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ কর্তৃক ২০০২ সালে বোস্তামীর কচ্ছপকে চরমভাবে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়। এই কচ্ছপের ওপর ২০০৭ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেল ডকুমেন্টারি তৈরি করে। এগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য- আকারে এই কচ্ছপ অনেক বড় হয় এবং ওজনও বেশি। কালের সাক্ষী হয়ে শত শত বছর এদের বেঁচে থাকার অপূর্ব ক্ষমতা আছে।
বাংলাদেশ সময়: ১২১৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০১৯
ইউডি/এসি/টিসি