ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

সিআরবিতে হাসপাতাল প্রকল্প বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২২৯ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০২১
সিআরবিতে হাসপাতাল প্রকল্প বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বক্তব্য দেন অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত। ছবি: উজ্জ্বল ধর

চট্টগ্রাম: সিআরবিকে নগরের ফুসফুস আখ্যা দিয়ে ৫০০ শয্যার নতুন হাসপাতাল ও ১০০ আসনের মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রকল্প বাতিল না করা পর্যন্ত লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ‘নাগরিক সমাজ চট্টগ্রাম’।  বৃহস্পতিবার (১৫ জুলাই) সিআরবির সাত রাস্তার মোড়ে নগরের বিশিষ্টজনদের আহ্বানে সব শ্রেণি-পেশার নাগরিকদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদী অবস্থান কর্মসূচি থেকে এ ঘোষণা দেওয়া হয়।

 

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত বলেন, চট্টগ্রামের মানুষ এখানে বেসরকারি হাসপাতাল চায় না। এ আন্দোলনে শুধু চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ নয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও শামিল হয়েছেন।

সবাই বলেছেন সিআরবি রক্ষা করতে হবে চট্টগ্রামের স্বার্থে। যতদিন হাসপাতাল নির্মাণের এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না হবে ততদিন চট্টগ্রামবাসী এ আন্দোলন পরিচালনা করবে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান এ সিআরবি। ঐক্যবদ্ধভাবে চট্টগ্রামের স্বার্থে আমরা এ আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাব।  

কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, এ সিআরবি আমাদের শৈশবের স্মৃতিধন্য স্থান। শুধু গাছ নয় আমরা সিআরবির পুরো জায়গাটাই রক্ষা করতে চাই। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতিধন্য সিআরবি। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে বহু মানুষ শহীদ হয়েছেন এখানে। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ২৪ ধারায় বলা আছে, ঐতিহাসিক স্থাপনা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান রক্ষা করতে হবে। তা এক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এখানে সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে উঠেছে। সিআরবি ভবন ব্রিটিশ স্থাপত্যের শেষ কয়েকটির একটি। রেলের যে হাসপাতাল সেটাকে পুনরুজ্জীবিত করে ব্যবহার উপযোগী করা যেতে পারে। কোনো বাণিজ্যিক হাসপাতাল নয়। পিপিপি মানে জনগণের টাকা, জনগণের টাকায় ধনীদের হাসপাতাল চাই না। এ সঙ্গে ডিসি হিল রক্ষার আন্দোলনও আমরা চালিয়ে যাব। সেখানে যাতে সুস্থ সংস্কৃতির চর্চার সুযোগ থাকে।  

খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগরীর সভাপতি ডা. একিউএম সিরাজুল ইসলাম বলেন, জনগণের টাকাই সরকারের টাকা। রেলের জমি বলে কিছু নেই, সব জনগণের সম্পতি। সরকারি কোনো জায়গায় কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হতে পারবে না। সিআরবি বা গোয়ালপাড়া নয় এখানে বেসরকারি হাসপাতাল হতে দেওয়া যাবে না। বেসরকারি হাসপাতালের চরিত্র করোনাকালে দেখেছি আমরা। চট্টগ্রামে একটা ক্যান্সার, অর্থোপেডিক, সরকারি শিশু হাসপাতাল বা হৃদরোগের বিশেষায়িত হাসপাতাল নেই। সরকারি হাসপাতাল করার উদ্যোগ নেন। এই প্রকল্প বাতিল না হলে আমরণ অনশন করব সবাইকে নিয়ে। একই সঙ্গে আমাদের ডিসি হিল রক্ষা করতে হবে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, রেলওয়ে বলছে এখানে হাসপাতাল হলে গাছ কাটা পড়বে না। গুনে দেখেছি তিনশ’ গাছ আছে শতবর্ষী গাছসহ। যা বলা হচ্ছে গাছ কাটা হবে না, তা সঠিক নয়। হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ হলে এ এলাকা ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রীকে যদি সঠিক তথ্য জানানো যায় তাহলে তিনি এ প্রকল্প বাতিল করবেন।  

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুচ বলেন, স্বাধীনতা বিরোধী চক্র বিএনপি নেতাদের গ্রুপ এখানে হাসপাতাল করতে চায়। এখানে ৯ জন শহীদের কবর আছে। শহীদের সমাধির ওপর রক্তাক্ত স্বাধীনতার ইতিহাস ম্লান করতে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের সব মানুষকে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। আজ রাজনীতিবিদের হাতে রাজনীতি নেই। মহিউদ্দিন চৌধুরী থাকলে কারো সাহস হতো না এখানে হাসপাতাল করার। চট্টগ্রামে কোনো পার্ক নেই। চট্টগ্রামের হৃৎপিণ্ড ধ্বংসের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ধনীদের প্রাইভেট হাসপাতাল আমরা চাই না। মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধির ওপর হাসপাতাল চাই না। প্রধানমন্ত্রী আপনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। বিনীত অনুরোধ প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত স্থানটি রক্ষা করুন।

দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান বলেন, সিআরবি এলাকা সিডিএ কর্তৃক হেরিটেজ ঘোষিত হয়েছে। এখানে হাসপাতাল হতে পারে না। রেল মন্ত্রণালয় তারপরও অনেক কিছু গোপন করে হাসপাতাল করতে চেয়েছে। আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, যদি সিআরবিতে চট্টগ্রামের মানুষ হাসপাতাল না চায় তাহলে হবে না। মানুষের চেতনা, নতুন প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি উপেক্ষা করে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করে কোনো উন্নয়ন হতে পারে না।

নগর আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বলেন, গোয়ালপাড়া কোনো সরকারি জায়গা না। ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গা। যে জমি একোয়ার করা হয়েছে সেটা হাসপাতাল কলোনি। যার আসল নাম শহীদ আবদুর রব কলোনি। বেশিরভাগ স্টাফদের বিদায় করে দেওয়া হয়েছে কলোনি থেকে। রেলের বক্তব্যের কোথাও নেই শহীদ আবদুর রব কলোনি একোয়ার করে হাসপাতাল হচ্ছে। তাই কৌশলে গোয়ালপাড়া বলছেন। চ্যালেঞ্জ করছি এটা গোয়ালপাড়া নয়। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আবদুর রবের বাবার বাসা। সে বাসা থেকে তিনি যুদ্ধে যান। যুদ্ধের ইতিহাস মুছে দিতে এখানে বাণিজ্যিক হাসপাতাল হতে পারে না। হাসপাতাল হলে মালিপাড়া, গোলায়পাড়া, এনায়েত বাজার, বাটালি রোডে মেডিক্যাল বর্জ্যের ভাগাড় হবে। তা হতে দেওয়া হবে না।  

অধ্যাপক মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, সমবেতরা সবাই চট্টগ্রামের স্বার্থে হাসপাতাল প্রকল্পের বিরোধিতা করছেন। এখানে যারা এসেছেন সবাই চট্টগ্রামকে ভালোবাসেন। আশাকরি এ হাসপাতাল প্রকল্প বাতিল করা হবে।  

সিপিবি নেতা নূরুচ্ছফা ভুঁইয়া বলেন, রেল কীভাবে এখানে প্রকল্প নিল সেটা তারাই ভালো বলতে পারবে। সবাই প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন। প্রধানমন্ত্রীকে যদি সবকিছু দেখতে হয় তাহলে বাকিরা কী করেন। সিআরবিতে ধনীদের জন্য হাসপাতাল বানিয়ে প্রকৃতি ধ্বংসের প্রক্রিয়া আমরা চাই না।  

পিপলস ভয়েসের সভাপতি শরীফ চৌহান বলেন, সিআরবিতে কোনোভাবে এ হাসপাতাল চাই না। প্রতিবাদকারীরা চট্টগ্রামকে রক্ষার জন্য এসেছেন। আশা করি সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। ধারাবাহিক কর্মসূচি থাকবে। সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকলে সরকারের সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হবে।  

কবি নাজিমুদ্দীন শ্যামল বলেন, কারা এ হাসপাতালের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত তা চট্টগ্রামের মানুষ জানে। আপনারা কারা? ইউনাইটেড বেনিয়া গ্রুপ। হাইব্রিডদের কথায় মানুষের স্বার্থ নষ্ট করবেন না। ইউনাইটেডের সঙ্গে বিএনপির নেতারা জড়িত, হাইব্রিড আওয়ামী লীগের নেতাদের আত্মীয়রা জড়িত। এ চট্টগ্রাম বন্দরও বেনিয়াদের দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল তা চট্টগ্রামের মানুষ ঠেকিয়ে দিয়েছে। সিআরবিও আমরা বেনিয়াদের হাতে দিতে দেব না।  

নগর আওয়ামী লীগ নেতা জামশেদুল আলম চৌধুরী বলেন, হাসপাতাল নির্মাণ রেলের কাজ না। ঐতিহ্য প্রকৃতি নষ্টের জন্য এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান এটি। যত বড় নেতা হন জনগণের বিপক্ষে গেল গণদুশমন হবেন।  

প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের সভাপতি রাশেদ হাসান বলেন, এ হাসপাতাল বেনিয়া স্বার্থে করা হবে। জনগণের স্বার্থ রক্ষা হবে না। বেসরকারি হাসপাতাল সাধারণ মানুষ কোনো সেবা পাবে না। আমরা সিআরবিতে কোনো হাসপাতাল চাই না। আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক বলয় সিআরবিকে অক্ষত রাখতে হবে।  

সাংবাদিক আলীউর রহমান বলেন, ইতিমধ্যে পরিবেশবাদী পাঁচ সংগঠন লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছে ১৫ দিনের মধ্যে প্রকল্প বাতিল না হলে আপনাদের হাইকোর্টের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। আইনে আছে খোলা স্থান জনসমাগমের স্থানে স্থাপনা করা যাবে না, লিজ দেওয়া যাবে না। রেলমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তার তীব্র নিন্দা জানাই।  

শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বাবু বলেন, কাউকে ভুল বোঝাবেন না এটা গোয়ালপাড়া বলে। মেয়র বলেছেন- জমি লাগলে তিনি দেবেন। জনগণের কাতারে আসুন সবাই। দেড় কোটি টাকায় ডিসি হিলে মঞ্চ করার পর আজ সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বন্ধ। শহীদ মিনার সরাতে চান। সিআরবি নিতে চান। কী বোঝাতে চাইছেন? প্রধানমন্ত্রীর কাছে আহ্বান আপনি ঘোষণা দিন হাসপাতাল সরে যাবে। হাসপাতাল হোক অন্য কোথাও।

বিএফইউজের যুগ্ম মহাসচিব মহসীন কাজী বলেন, আমরা সিআরবিতে কোনো হাসপাতাল চাই না। সিআরবি চট্টগ্রামের ফুসফুস। প্রধানমন্ত্রী পরিবেশের সুরক্ষা করেই উন্নয়ন প্রকল্প নেন। প্রকৃত তথ্য জানতে পারলে আশাকরি তিনি এ প্রকল্প বাতিল করবেন।  

আবৃত্তিশিল্পী প্রণব চৌধুরীর সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য দেন সিনিয়র সাংবাদিক আসিফ সিরাজ, ঋত্বিক নয়ন, নগর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আ ফ ম সাইফুদ্দিন, চট্টগ্রাম জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি এনি সেন প্রমুখ। প্রতিবাদী আবৃত্তি পরিবেশন করেন রাশেদ হাসান ও মিলি চৌধুরী।  

সংহতি জানান বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী চট্টগ্রামের আহ্বায়ক মাহবুবুর রহমান চৌধুরী, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ, কবি কামরুল হাসান বাদল, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শুকলাল দাশ, সাংস্কৃতিক সংগঠক শীলা দাশগুপ্তা, ন্যাপ নেতা মিঠুল দাশগুপ্ত, হাসান মনসুর নগর কৃষক লীগ নেতা হুমায়ন কবির মাসুদ, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শাহাদাত নবী খোকা, সাংবাদিক মহররম হোসেন, পার্থ প্রতিম বিশ্বাস, আমিন মুন্না, রাহুল দত্ত, টিটু দত্ত, মিনহাজুল ইসলাম ও বিনয় ভৌমিক প্রমুখ।  

সংহতি জানায় আমরা কৃষকের সন্তান পরিষদ, প্রমা, বোধন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী চট্টগ্রামের আহ্বায়ক কমিটি, খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগর, ছাত্র ইউনিয়ন, উদীচী চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ মানবাধিকার ও পরিবেশ ফাউন্ডেশন, আমরা চট্টগ্রামবাসী, স্মাইল বাংলাদেশ, মানবিক সংগঠন মুসাফির, বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশন দক্ষিণ জেলা, ভয়েস অব চট্টগ্রাম, জাগো চট্টগ্রাম বাঁচাও সিআরবি, অদিতি সঙ্গীত নিকেতন প্রভৃতি।  

শেষ চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনরা প্রস্তাবিত হাসপাতাল এলাকায় বৃক্ষরোপণ করেন। একই দাবিতে মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করে বিভিন্ন সামাজিক ও অরাজনৈতিক সংগঠন।  

বাংলাদেশ সময়: ২২১৮ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০২১
এআর/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।