চট্টগ্রাম: মাত্রাতিরিক্ত দখল, দূষণ, ভরাটের বিপরীতে নদীশাসন না থাকায় দেশের লাইফলাইন খ্যাত কর্ণফুলী নদী এখন বিপন্ন। প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী, কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ, দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর, বন্দরনগরের ৭০ লাখ মানুষের সুপেয় পানির উৎস, মানুষের জীবন ও জীবিকা এই নদীকে ঘিরে।
রোববার (২৬ সেপ্টেম্বর) বিশ্ব নদী দিবস। নদী সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে দিবসটি পালন করা হয়।
২০০৫ সালে জাতিসংঘ নদী রক্ষায় জনসচেতনতা তৈরি করতে ‘জীবনের জন্য জল দশক’ ঘোষণা করে। সে সময়ই জাতিসংঘ দিবসটি অনুসমর্থন করে। এরপর থেকেই জাতিসংঘের বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা দিবসটি পালন করছে, যা দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে। দূষণে-দখলে মৃতপ্রায় নদী বাঁচাতে বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
২০১৯ সালে কর্ণফুলীর উত্তর পাড়ে সদরঘাট থেকে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত ২ কিলোমিটার এলাকার ২৩০টি অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়ে প্রায় ১০ একর জায়গা উদ্ধার করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। উচ্ছেদ করা জায়গা ফের বেদখল হলে পুনরায় উচ্ছেদ অভিযান চালায় বন্দর কর্তৃপক্ষ ও জেলা প্রশাসন।
কিন্তু নানান কারণ ও সীমাবদ্ধতায় দুই তীরে অনেক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হয়নি এখনো। উদ্ধার করা জায়গা আবারও দখল হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিয়মিত ড্রেজিং করে জেটিতে জাহাজ আনা-নেওয়ার চ্যানেল ঠিক রাখলেও নদীর তলদেশে মাত্রাতিরিক্ত পলিথিন ও কঠিন বর্জ্যের কারণে ড্রেজিংয়ে হিমশিম খাচ্ছে।
এ অবস্থায় নদী কমিশন, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়, বন্দর কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদফতর, জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বিআইডব্লিউটিএ, সিটি করপোরেশন, নদী গবেষকসহ সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়ে একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে মৃতপ্রায় কর্ণফুলীকে বাঁচানো সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কর্ণফুলীর পানি ধারণক্ষমতা কমে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুমে অমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারে প্লাবিত হচ্ছে নগরের চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ-আসাদগঞ্জ, আগ্রাবাদ, হালিশহর, বাকলিয়া, চান্দগাঁওসহ নিম্নাঞ্চল। জোয়ারের পানিতে ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই ও আসাদগঞ্জের ৫ হাজার দোকান, আড়ত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
নগরের ৩৬টি খাল ও নালা দিয়ে প্রতিদিন ২ হাজার ২০০ টন বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই কর্ণফুলী নদীতে পড়ছে। এছাড়া ৫২টি খাল ও নালার মুখ রয়েছে কর্ণফুলী নদী অভিমুখে। এতে পলিথিন, বোতল, কাপড়সহ অন্যান্য পদার্থের শক্ত স্তর হচ্ছে। একইভাবে অপরিশোধিত তরল বর্জ্যের কারণে নদীতে দূষণের মাত্রা বেড়েছে।
একইভাবে চাক্তাই খালসহ বেশ কয়েকটি বড় খাল-নালা দিয়ে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে পড়ছে। বুয়েটের তথ্যমতে, কর্ণফুলী নদীর সদরঘাট থেকে উজানে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত এলাকায় ২ মিটার থেকে ৭ মিটার পর্যন্ত কঠিন বর্জ্যের স্তর পড়েছে। এর ফলে ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের আওতায় ওই এলাকায় কাজ চালিয়েও ফল পায়নি।
কর্ণফুলী গবেষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী বাংলানিউজকে বলেন, কর্ণফুলী নদী আমাদের জাতীয় অর্থনীতির মূলধন। এটি শুধু বাংলাদেশের ঐতিহ্য নয় একটি অর্থকরী নদীও। দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামের সব কনটেইনার জাহাজগুলো কিন্তু এ নদী দিয়েই আসা-যাওয়া করছে। তাই এ নদীকে পরিচর্যা করতে হবে বিজ্ঞানভিত্তিক ও যৌক্তিক উপায়ে।
তিনি বলেন, নদীর দুই পাড় নানাভাবে, নানা অজুহাতে দখল হচ্ছে। নদীর জায়গায় স্থায়ী স্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে। নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে। মাছসহ জলজ প্রাণির অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হচ্ছে। হাজার হাজার লাইটার জাহাজ কর্ণফুলী নদীকে টার্মিনাল হিসেবে ব্যবহার করছে। লাইটার, ট্যাংকার, কনটেইনার শিপ, ট্রলারের জ্বালানি তেল, তৈলাক্ত বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ছে। এভাবে ক্রমে নদীটি মরে যাচ্ছে।
এদিকে নদ-নদী রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। ২৫ বছর মেয়াদি ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণের পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণও শুরু হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা রক্ষায় চট্টগ্রাম বন্দরকে প্রধান ভূমিকা রাখার সুপারিশ করা হয়। বৈঠকে কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে নগরের সব খাল, নালা-নর্দমার মুখে পলিথিনসহ কঠিন বর্জ্য আটকানোর জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব উদ্যোগে নেট স্থাপন করার সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২১
ইউডি/এসি/টিসি