ঢাকা, বুধবার, ১২ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ জুন ২০২৪, ১৮ জিলহজ ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

সালতামামি-২০২১

চট্টগ্রামের আদালত: আলোচিত যত ঘটনা

মিনহাজুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০২১
চট্টগ্রামের আদালত: আলোচিত যত ঘটনা ...

চট্টগ্রাম: মহামারি করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে খানিকটা ব্যাহত হলেও দুই শারীরিক আর ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতির মাধ্যমে কার্যক্রম চলেছে চট্টগ্রাম জেলা দায়রা জজ, মহানগর দায়রা জজ, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটআদালত। বছরজুড়ে এই অঙ্গনে আলোচিত বদলি জেল খাটা মিনু, হাসিনা আক্তারের সাজা খাটছেন হাছিনা বেগম, মিতু হত্যা মামলা, ওসি প্রদীপের মামলা, মামলার নথি থেকে আইনজীবীর চেক চুরি এবং পুলিশ হত্যা তদন্তে পুলিশের গাফিলতি।

বদলি জেল খাটা মিনু

একটি হত্যা মামলায় কুলসুম আক্তার কুলসুমীকে যাবজ্জীবনসহ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ১ বছরের কারাদণ্ড দেন। আর আদালতে আত্মসমর্পণ করে সাজা খাটছেন মিনু আক্তার।

২ বছর ৯ মাস ১০ দিন পরে কোনো কিছুর মিল থাকায় একজনের স্থলে আরেকজন জেল খাটার বিষয়টি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. শফিকুল ইসলাম খান আদালতের নজরে আনেন। গত ২২ মার্চ সকালে অতিরিক্ত চতুর্থ মহানগর দায়রা জজ শরীফুল আলম ভূঁঞার আদালতে পি, ডব্লিউ মূলে মিনুকে আদালতে হাজির করা হয়েছিল। একই আদালত জবানবন্দি শুনে এ মামলার আপিল উচ্চ আদালতে বিচারাধীন থাকায় মিনুর উপ-নথি গত ২৩ মার্চ হাইকোর্টে পাঠানোর আদেশ দেন।

গত ২২ মার্চ বাংলানিউজে ‘এক নারীর সাজা খাটছেন অন্য নারী!’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পরে গত ৩১ মার্চ বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো.মোস্তাফিজুর রহমানের ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। পরে বিষয়টি নজরে এনে মেনশন স্লিপ দিয়েছিল। গত ৭ জুন হাইকোর্টের বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল বেঞ্চ গত ৭ জুন মিনুকে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে মূল আসামি কুলসুমীকে দ্রুত গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর নিরপরাধ মিনুর জেল খাটার ঘটনায় তিন আইনজীবী ও এক ক্লার্ককে তলব করেন হাইকোর্ট।

গত ১৬ জুন বিকেলে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে প্রায় ৩ বছর বিনা অপরাধে সাজাভোগের পর মুক্তি পেয়েছিলেন মিনু। গত ২৮ জুন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর ‘অজ্ঞাত’ হিসেবে মিনুর মরদেহ দাফন করা হয়। এ ঘটনায় বায়েজিদ বোস্তামী থানায় ২৯ জুন একটি মামলা হয়। ট্রাকচাপায় মিনু আক্তারের মৃত্যুকে অস্বাভাবিক দাবি করেন মিনুর আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ। মিনুর মৃত্যুকে ঘিরে জন্ম নিয়েছে নানা প্রশ্নের। কুলসুম আক্তার কুলসুমীর বদলে মিনু চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে মূল আসামি সেই কুলসুমীকে গত ২৯ জুলাই ভোরে নগরের পতেঙ্গা এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে কোতোয়ালী থানা পুলিশ।

গত ১ সেপ্টেম্বর বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. আতোয়ার রহমানের ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চে হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কুলসুম আক্তারের হয়ে জেল খাটা মিনুর গাড়িচাপায় মৃত্যুর ঘটনায় সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এবং আটক কুলসুমের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ঘটনায় নথিসহ দুই তদন্ত কর্মকর্তা হাইকোর্টে হাজির হয়েছেন। মিনু আক্তারের দুই সন্তান ইয়াসিন (১২) ও গোলাপের (৯) পড়ালেখা ও ভরনপোষণের দায়িত্ব নিয়েছে ইস্পাত নির্মাণ শিল্পগ্রুপ কেএসআরএম।  

হাসিনা আক্তারের সাজা খেটেছেন হাছিনা বেগম

মাদকের মামলায় ৬ বছর কারাদণ্ডের আদেশ হয়েছিল হাসিনা আক্তারের। তার জায়গায় ১ বছর সাড়ে ৪ মাস ধরে সেই সাজা খাটছিল হাছিনা বেগম। বিষয়টি চট্টগ্রাম মহানগর অতিরিক্ত ৫ম আদালতের নজরে আনেন অ্যাডভোকেট গোলাম মাওলা মুরাদ। কারাগারে থাকা হাছিনা বেগমের অপরাধীর তালিকায় নাম নেই। অপরাধ একটাই, সাজাপ্রাপ্ত আসামির নামের প্রথম অংশ ও স্বামীর নামের সঙ্গে মিল। তবে অপরাধীর নামের সঙ্গে মিল থাকলেও বাবা-মায়ের নামের সঙ্গে রয়েছে অমিল। গত ৪ মে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ৪র্থ আদালতের বিচারক শরীফুল আলম ভূঁঞার ভার্চুয়াল আদালতে কারাগারের ছবিযুক্ত বালামে প্রকৃত আসামি হাসিনা আক্তার ও কয়েদি হাছিনা বেগম একই নন বলে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। এইদিন আদালত মুক্তির আদেশ দেন। একইদিন বিকেলে হাছিনা বেগম ১ বছর ৪ মাস ২০ দিন পর সাজা ভোগ করা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিল।

মিতু হত্যা মামলা

পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যা মামলায় বছর জুড়ে আলোচনায় ছিল। মিতু হত্যাকাণ্ডের পর নগরের পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাত পরিচয়ের কয়েকজনকে আসামি করে একটি মামলা করা হয়, যার বাদী ছিলেন বাবুল আক্তার নিজেই। গত ১০ মে মামলার বাদি হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো কার্যালয়ে ডেকে আনা হয় বাবুল আক্তারকে। পরে ১২ মে মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন বাদি হয়ে পাঁচলাইশ থানায় বাবুল আক্তারসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। একই দিন মামলায় বাদী থেকে  আসামী বাবুল আক্তারকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে মঞ্জুর করেন আদালত। পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে গত ১৭ মে  বাবুল আক্তার জবানবন্দি দিবে বলে আদালতে হাজির করারও হলেও জবানবন্দি দেয়নি তিনি। গত ২৩ আগস্ট মাহমুদা খানম মিতু হত্যার ঘটনায় সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের পাঁচলাইশ থানায় দায়ের করা মামলার সব কাগজপত্র জুডিশিয়াল হেফাজতে রাখার আদেশ দিয়েছিল আদালত । গত ৩ নভেম্বর মাহমুদা খানম মিতু হত্যার ঘটনায় নিজের করা মামলায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন থেকে পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবে কিছু জবানবন্দি মামলার ডকেট থেকে সরিয়ে রাখা বা গােপন করার দাবি করে বাবুল আক্তারের পক্ষে আদালতে আবেদন করা হয়েছিল। এছাড়া পিবিআইয়ের তদন্তকে ‘সফল বললেও ‘টেকনিক্যাল ত্রুটি উল্লেখ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করেননি আদালত। অধিকতর তদন্ত করে পুনরায় প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন।

ওসি প্রদীপ 

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার আসামি ও কক্সবাজারের টেকনাফ মডেল থানার বরখাস্ত হওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ ও তাঁর স্ত্রী চুমকি কারনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন গত ২৬ জুলাই। দুদকের দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়, চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় ছয়তলা বাড়ি, ষোলশহরের বাড়ি, ৪৫ ভরি সোনা, একটি কার, একটি মাইক্রোবাস, ব্যাংক হিসাব এবং কক্সবাজারের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে চুমকির নামে। তাঁর ৪ কোটি ৮০ লাখ ৬৪ হাজার ৬৫১ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বিপরীতে বৈধ ও গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া যায় ২ কোটি ৪৪ লাখ ৬৬ হাজার ২৩৪ টাকা। ২ কোটি ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার ৪১৭ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের সত্যতা পেয়েছে দুদক। এ ছাড়া চুমকি নিজেকে মৎস্য ব্যবসায়ী দাবি করলেও এ ব্যবসার কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অভিযোগপত্রে সাক্ষী রাখা হয়েছে ২৯ জনকে। গত ২৯ জুন দুপুরে চট্টগ্রামের আদালত প্রদীপ কুমার দাশের অবৈধ সম্পদ দেখভালের দায়িত্ব কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসককে দেন।

গত ২০ সেপ্টেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা করা আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত প্রদীপ ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের করা অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলার এজাহারে উল্লিখিত সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দেন। গত ১৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও তাঁর স্ত্রী চুমকি কারনের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়েছে। বিচারক অভিযোগ গঠনের পর তা পড়ে শুনালে ওসি প্রদীপ নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন।  

মামলার নথি থেকে আইনজীবীর চেক চুরি

যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ ৫ম আদালত থেকে গত ৯ সেপ্টেম্বর  মামলার নথি থেকে ২৭ কোটি ৯৭ লাখ ৮৮ হাজার ৭২ টাকার চেক চুরি করেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য জোবায়ের মােহাম্মদ আওরঙ্গজেব। জোবায়ের মােহাম্মদ আওরঙ্গজেবের বারের সনদ নম্বর-২০১২০৪৪২৪৮। এ ঘটনায় চট্টগ্রাম মহানগর যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ ৫ম আদালতের বিচারক মো. জহির উদ্দিন মহানগর দায়রা জজ শেখ আশফাকুর রহমানের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এ ঘটনায় জোবায়ের মোহাম্মদ আওরঙ্গজেবকে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। চেক চুরির ঘটনায় এসএ গ্রুপের আইনজীবী না হয়েও, বিভিন্ন গণমাধ্যমে গ্রুপের হয়ে বক্তব্য দেওয়ায় গত ২৭ সেপ্টেম্বর একটি মামলা দায়ের করেন শিল্পগ্রুপটি।  

পুলিশ হত্যা তদন্তে পুলিশের ‘গাফিলতি’

চান্দগাঁও থানার একটি পুলিশ হত্যা মামলার তদন্তে পুলিশের ‘গাফিলতি’ ছিল বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছেন গত ১৫ নভেম্বর চতুর্থ অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ শরীফুল আলম ভূঁঞার আদালত। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, পুলিশের মামলায় পুলিশ গাফিলতি ও সহকর্মীর হত্যা মামলা হিসেবে উদাসীনতা ও অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। একজন সহকর্মীর মামলায় পুলিশ যে আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে, আসলে আমাদের স্তম্ভিত করে দিয়েছে। আদালত পর্যবেক্ষণে তাদের তিরষ্কার করেছেন এবং পূর্ণাঙ্গ রায়ে পুলিশ মামলার প্রতি উদাসীনতার বিষয়ে একটি আদালতের অভিমত আসবে। মামলার বিষয়টা চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনারের নজরে আনবেন বলে অভিমত প্রকাশ করেন আদালত।  

বাংলাদেশ সময়: ১৯৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০২১
এমআই/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।