ঢাকা: খুচরা পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আদায়ে ইলেকট্রনিক্স ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) বসানো হয়েছিল। তবে এক-তৃতীয়াংশ দোকান এই মেশিন ব্যবহার করছে না।
রাজস্ব আদায় বাড়াতে ২০২৩ সালের ২২ আগস্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেনেক্স ইনফোসিসের সঙ্গে চুক্তির আওতায় রাজধানী ঢাকা ও বাণিজ্যিক শহর চট্টগামে ৯ হাজার ইএফডি মেশিন বসায় এনবিআর। এক বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ২০ হাজার মেশিন সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতির বিপরীতে কেবল ৯ হাজার মেশিন সরবরাহ করে।
চুক্তি অনুযায়ী একশ টাকা ভ্যাটের বিপরীতে আদায়কারী প্রতিষ্ঠান জেনেক্স ইনফোসিস কমিশন পাবে ৫৩ পয়সা। চুক্তি অনুযায়ী ইএফডি সরবরাহ না করায় অনলাইনে ভ্যাট আদায়ের কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে।
এনবিআর সূত্র জানায়, এনবিআর থেকে এসব মেশিন তদারকির ব্যবস্থা রয়েছে। দোকানদার কত টাকা বিক্রি করছেন, এই বিক্রি থেকে মূসক বাবদ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কত পাবে, কত টাকা আদায়কারী প্রতিষ্ঠান পাবে—দোকানে না গিয়েই তা জানতে পারবে এনবিআর।
তথ্য অনুযায়ী, ইএফডি মেশিন বসানোর দেড় বছর পার হলেও তিন হাজার ইএফডি মেশিন ব্যবহার করে পণ্য বিক্রি হয়নি, ফলে কোনো ভ্যাটও আদায় হয়নি। এখন এসব মেশিন প্রত্যাহার করে জুয়েলারি দোকানে বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
মেশিন সরবরাহ না করায় কারণ দর্শানোর নোটিশ
চুক্তি অনুযায়ী প্রথম বছরেই ২০ হাজার ইএফডি মেশিন সরবরাহ করার কথা ছিল। কিন্তু ৯ হাজার মেশিন সরবরাহ করার পর আর কোনো মেশিন সরবরাহ করেনি কোম্পানিটি। এর ফলে বাকি দোকানে আর ইএফডি মেশিন সরবরাহ করা যায়নি। মেশিন না পাওয়া দোকান স্বয়ংক্রিয় ভ্যাট আদায় ছাড়াই পণ্য বিক্রি করছে। ফলে মেশিন না পাওয়া দোকান এনবিআরের তদারকির বাইরে থেকে যাচ্ছে।
চুক্তি অনুযায়ী ইএফডি মেশিন সরবরাহ না করাতে জেনেক্স ইনফোসিসকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় এনবিআর। গ্রহণযোগ্য জবাব না পাওয়ায় চালু থাকা ছয় হাজার ইএফডি মেশিনের মাধ্যমে আদায় করা ভ্যাট থেকে জেনেক্স ইনফোসিসের কমিশন বন্ধ রয়েছে।
ইএফডি কার্যকর না হওয়া প্রসঙ্গে এনবিআরের বক্তব্য
চুক্তি অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ইএফডি মেশিন সরবরাহ না করায় সব দোকানে মেশিন সরবরাহ করতে পারেনি এনবিআর। আবার সব দোকানদারও ইএফডি মেশিন ব্যবহারে উৎসাহী নন। এটা ইএফডি সফল না হওয়ার অন্যতম কারণ। দোকানদাররা প্যাকেজ ভ্যাট দিতে বেশি আগ্রহী। এতে ভ্যাট আদায়ে আধুনিকায়নের যে উদ্যোগ, তা সফল হচ্ছে না।
সরেজমিনে যা দেখা যায়
সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন দোকানে গিয়ে দেখা গেছে, ইএফডি মেশিন থাকার পরও অধিকাংশ দোকানদার মেশিন ব্যবহার করে পণ্য বিক্রি করতে আগ্রহী নন। তিনটি মিষ্টির দোকানসহ সাতটি দোকানে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ইএফডি মেশিন ব্যবহারে চারটি দোকানের অনীহা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্রেতারাও ভ্যাট দিয়েও রশিদ নিতে আগ্রহী নন। দোকানদার ক্রেতার কাছে থেকে ভ্যাটসহ দাম রাখলেও সরকারের খাতায় ভ্যাট জমা পড়ছে না। এর ফলে ভ্যাট আদায়ে কোনো উদ্যোগই পুরোপুরি কাজে আসছে না।
ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ের কাস্টমসের কর্তাদেরও আগ্রহ কম। অনলাইনে ভ্যাট আদায়ের পরিবর্তে ম্যানুয়ালি আদায় করলে কাস্টমসের কর্মকর্তারা কিছু ‘উপরি’ নিয়ে প্যাকেজ পদ্ধতিতে নামে মাত্র টাকার ভ্যাট রশিদ দিয়ে যান। দোকানদারও এতে খুশি থাকেন।
দোকান মালিক সমিতি যা বলছে
দেশের দুই শহরে বসানো ৯ হাজার ইএফডি মেশিনের মধ্যে ৩ হাজার মেশিন কার্যকর নয়। এসব মেশিন কাজই শুরু করেনি। যেসব দোকান ইএফডি মেশিন ব্যবহার করছে, সেগুলোও পুরোপুরি কার্যকর নয়। এর পেছনে এনবিআরের উদ্যোগের অভাব রয়েছে বলে মনে করছেন ঢাকা মহানগর দোকান ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি মো. আরিফুর রহমান টিপু।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, প্রথমত এনবিআর সব দোকানে ইএফডি মেশিন দিতে পারেনি। একই মার্কেটে কিছু দোকানকে দিয়েছে, বাকিদের দেয়নি। ফলে যারা মেশিন পেয়েছে, তারা ভ্যাট যোগ করে বাড়তি দামে পণ্য বিক্রি করছে। যারা মেশিন পায়নি তারা ভ্যাট ছাড়াই বিক্রি করছে। তারা প্যাকেজে কিছু টাকা দিয়ে কম দামে পণ্য বিক্রি করতে পারছে। এর ফলে ইএফডি মেশিন পাওয়া দোকানদাররা গ্রাহক হারাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, ইএফডি মেশিন ব্যবহার করে পণ্য বিক্রি করতে হলে বিক্রির শুরুর আগে কেনা পণ্যের দামসহ পণ্যের বিস্তারিত ইএফডিতে ইনপুট দিতে হবে। এই ইনপুট দেওয়ার মতো অভিজ্ঞ লোক নিয়োগ দেওয়ার সক্ষমতা বেশির ভাগ দোকানের নেই। আবার দোকানদারদের ট্রেনিং দেওয়ার কথা থাকলেও সেটা করা হয়নি। তাই তারা ইএফডি মেশিন ব্যবহারে নিরুৎসাহী হচ্ছে।
তৃতীয়ত, ইএফডি মেশিন ব্যবহার বাবদ প্রতি মাসে দোকানদারের কাছ থেকে বাড়তি টাকা কেটে নেওয়া হবে। এজন্যও ইএফডি মেশিন ব্যবহারের আগ্রহ নেই, বলেন ঢাকা মহানগর দোকান ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি।
জুয়েলারির দোকানে ইএফডি মেশিন ব্যবহারে আগ্রহী এনবিআর
অনলাইনে ভ্যাট আদায়ের সম্ভাবনা বিবেচনা করে প্রাথমিকভাবে দেশের দুই বড় শহরে ইএফডি মেশিন বসানো হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে সারা দেশে ইএফডি মেশিন বসানোর কথা ছিল। এটা কার্যকর করতে ইএফডি ব্যবহারকারী দোকানদারদের লটারির মাধ্যমে পুরস্কারও দেওয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু চুক্তি হওয়া প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় সক্ষমতা না থাকা, মাঠ পর্যায়ে দোকানদারদের অসহযোগিতা ও রাজস্ব আদায়কারী কর্মকর্তাদের ‘উপরি’ হাতছাড়া না করতে চাওয়ার মানসিকতার কারণে ইএফডি কার্যক্রম পুরোপুরি সফল হচ্ছে না।
এ অবস্থায় অব্যবহৃত ইএফডি মেশিনসহ চুক্তি অনুযায়ী আরও ইএফডি মেশিন সরবরাহ পেতে উদ্যোগ নিচ্ছে এনবিআর। এসব ইএফডি মেশিন জুয়েলারি দোকানে বসানো হবে। এ জন্য জুয়েলারি দোকানগুলোকে রেজিস্ট্রেশনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২৫
জেডএ/এমজেএফ