ঢাকা, বুধবার, ২২ মাঘ ১৪৩১, ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৫ শাবান ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

মানববর্জ্য থেকে ‘যৌবন সার’ কৃষিতে নতুন দিগন্ত!

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৪
মানববর্জ্য থেকে ‘যৌবন সার’ কৃষিতে নতুন দিগন্ত! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: মাঠ জুড়ে সবুজের সমারোহ। ফসলের ক্ষেতে মোটা মোটা পাইপ দিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তরল সার! স্প্রে করা এই সারে নেই কোনো রাসায়নিক উপাদান।

আদর করে স্থানীয় চাষিরা এ সারের নাম দিয়েছেন ‘যৌবন সার’, যা এক ধরনের জৈবসার।

আর এই সারের একমাত্র উপাদান হচ্ছে- মানুষের বর্জ্য- মলমূত্র।

মানববর্জ্যে দিয়ে তৈরি এই সারই এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সাভারে। এই সার ব্যবহারে খরচ খুবই কম, লাভ বেশি। আবার ফলনও হচ্ছে বিষমুক্ত।

নতুন এই পদ্ধতি নানাভাবে সুফল এনে দিয়েছে চাষাবাদে। একদিকে যেমন বাসা-বাড়ির টয়লেট পরিস্কারে বাড়তি অর্থ গুনতে হবে না, তেমনি বাসা-বাড়ির বর্জ্য দিয়েই মিটে যাবে জৈবসারের চাহিদাও।

সাভারের যাদুরচর গ্রাম থেকে শুরু হয়, মানবনির্গত বর্জ্যের  জৈবসারের ব্যবহার। খবরটি ছড়িয়ে পড়লে এর আশেপাশের গ্রামগুলোতেও এর ব্যবহার দ্রুত বেড়ে যায়।

মানববর্জ্যকে কাজে লাগিয়ে জৈবসারে রূপান্তরের নেপথ্যে কারিগর হচ্ছেন লন্ডন প্রবাসী যুবক সরকার তাসেক। তার  অদম্য চেষ্টাতেই এখন গ্রামজুড়ে মানুষের মুখে এই সারের কথা ছড়িয়ে পড়েছে। সে কারণে মানববর্জ্যের এখন জয়জয়কার।

বিবেক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সরকার তাসেক বাংলানিউজকে জানান, মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহারের ফলে জমি উর্বরতা হারাচ্ছে। মারাত্মকভাবে উৎপাদন ক্ষমতা হারাচ্ছে এ সব ভূমি।

তিনি বলেন, আমার ইচ্ছা ছিল, দেশবাসীকে সুস্বাদু ও বিষমুক্ত খাদ্য উপহার দেওয়া। একইভাবে রাসায়নিক সারের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমানো। পাশাপাশি শস্য উৎপাদনে চাষিদের মধ্যে সাশ্রয়ী উপকরণ তুলে দেওয়া।

তার কথার সত্যতা মিললো যাদুরচর গ্রামে। সেখানে মানববর্জ্য এখন আর ফেলনা নয়। এই বর্জ্যকে কাজে লাগিয়ে স্বনির্ভর হয়ে উঠেছেন সাভারের চাষিরা। জৈবসারের ব্যবহারে মাঠে মাঠে এখন সবুজ ফসলের হাতছানি।

সরকার তাসেক বাংলানিউজকে জানান, মানববর্জ্যকে নির্দিষ্ট সময় পর কম্পোস্ট সার তৈরি করলে স্বাস্থ্য ও পরিবেশের কোনো ক্ষতির আশঙ্কা নেই। বরং তা নানাভাবে জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করছে।

মানববর্জ্য ব্যবহারকারী লালমিয়া বাংলানিউজকে জানান, ছয়মাস পর মল শুকিয়ে জৈব সারে পরিণত হয়।

মানুষের মূত্রে ক্ষারের (অ্যাসিড) পরিমাণ বেশি- এ কথার জবাবে  সরকার তাসেক জানালেন, মানুষের প্রস্রাবের (মূত্র) সঙ্গে ৫ গুণ পানি মিশিয়ে ‘নাইট্রোজেন’ হিসেবে তা ফলজ গাছপালা ও ফসলে ব্যবহার করা যায়, যা প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য উপকারীও বটে।

এ বিষয়ে সাভার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুস সালাম বাংলানিউজকে জানান, লন্ডনপ্রবাসী যুবক সরকার তাসেক যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার।

তিনি জানান, সবাই পথ চলেন, কিন্তু পথ দেখান একজন। সরকার তাসেক আজ যে পদ্ধতি ছড়িয়ে দিচ্ছেন, তা হয়ত একদিন এর কোনো বিকল্প থাকবে না।

তিনি বলেন, সব প্রাণীর বর্জ্য এক সময় জৈবসারে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে মানব বর্জ্যও নির্দিষ্ট সময়ের পর জৈবসার হিসেবে কৃষিক্ষেতে ব্যবহার করলে ক্ষেত ভালো থাকবে।

যাদুরচর গ্রামের মুদি দোকানদার আক্কাস আলী বাংলানিউজকে জানান, তার কোনো ফসলি জমি নেই। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে তার বাড়ির টয়লেটের সেপটিক ট্যাংক পরিস্কার করতে সুইপার খুঁজতে হতো। ব্যয় হতো হাজারখানেক টাকা।

তিনি জানালেন, এখন পরিস্থিতি বরং উল্টো। স্থানীয় চাষিরা পাম্পের মাধ্যমে সংগ্রহ করে নেয় তার বাড়ির পয়ঃবর্জ্য। এ জন্য টাকা দিতে হয় না বরং বিনামূল্যেই চাষিরা সংগ্রহ করছেন এই জৈবসার।

সাভারের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের হেমায়েতপুর, যাদুরচর, মধুরচর, জয়নারবাড়ীসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেল সেখানকার কৃষকরা মানববর্জ্য ব্যবহার করছেন জৈবসার হিসেবে।

জয়নাবাড়ির কৃষক আব্দুস সাত্তার বাংলানিউজকে জানান, এই সার ব্যবহারে উৎপাদিত সবজি পুষ্টিকর ও সুস্বাদু।
যাদুরচর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার সেপটিক ট্যাংকগুলোতে লম্বা হোস পাইপের মাধ্যমে মানববর্জ্য তুলে পাম্প করে তা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সবজিক্ষেতে।

কৃষক আলী মিয়া বাংলানিউজকে জানান, এ পদ্ধতিতে বিঘাপ্রতি জমিতে এই সার প্রয়োগ করতে খরচ মাত্র ৬শ থেকে ৭শ টাকা। আর এই জৈবসার ক্ষেতে বছরে একবার দিলেই চলে।

অন্যদিকে, ২০ কেজির এক বস্তা ফসফেট কিনতে এক হাজার ৫শ  থেকে এক হাজার ৬শ টাকা লাগে। এক্ষেত্রে বছরে বিঘাপ্রতি রাসায়নিক সার ব্যবহার বাবদ খরচ ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পড়ে।

এভাবেই গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে মানববর্জ্য দিয়ে তৈরি জৈবসার দিয়ে কৃষকরা আবাদ করেছেন সরিষা, গম, মিষ্টি আলু, কুমড়া, লাউ, লালশাক, ধনে, মরিচ, বেগুনসহ শীতকালীন নানা শাকসবজি।

এ পদ্ধতির প্রচলনকারী লন্ডন প্রবাসী সরকার তাসেক বাংলানিউজকে জানান, উষ্ণতা মোকাবেলায় বিশ্বজুড়েই যখন বিকল্প জ্বালানি হিসেবে পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি  নিয়ে কাজ চলছে তখন আমাদের মতো কৃষিপ্রধান দেশগুলোতে এভাবে জৈবসারের ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে আনতে পারি।

তিনি জানালেন, এ সার ব্যবহার করলে মাটি আঠালো হয়। ফলে, জমির পানির ধারণ ক্ষমতা ও উর্বরা শক্তি বেড়ে যায়। সেচে অতিরিক্ত পানি প্রয়োজন হয় না বলে সেচ খরচও কম। আবার মানববর্জ্য ব্যবহার করায় দ্রুত ফসল ফলছে।

তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব জামাল উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, সরকার তাসেক যে পদ্ধতির প্রচলন শুরু করেছেন, তার মাধ্যমে আমাদের এলাকায় একধরনের কৃষি বিপ্লব শুরু হয়েছে। ঘরে ঘরে এখন মানুষ সচেতন হচ্ছে রাসায়নিক সারের বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে।

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মানববর্জ্যকে প্রক্রিয়াজাত করে জৈবসার হিসেবে তারা ব্যবহার করছেন ফসলের ক্ষেতে। এভাবেই নতুন এক ‘সবুজ বিপ্লব’ ছড়িয়ে পড়ছে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে!

বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।