ঢাকা, বুধবার, ২৩ পৌষ ১৪৩১, ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭ রজব ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

১২ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি

প্রিন্সের কারখানায় কড়া নজরদারি

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০১৫
প্রিন্সের কারখানায় কড়া নজরদারি ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: জালিয়াতি, প্রতারণা আর মিথ্যে ঘোষণার মাধ্যমে প্রিন্স গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠানের ১২ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকির খোঁজ পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

প্রতিষ্ঠান দু’টি হলো- মেসার্স প্যারাডাইজ ফুড প্রডাক্টস লিমিটেড ও প্রিন্স ফুড প্রডাক্টস লিমিটেড।



কাস্টমস এক্সসাইজ ও ভ্যাট বিভাগ বলছে, প্রতিষ্ঠান দু’টি ভোক্তাদের কাছ থেকে আদায় করা ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেছে।
 
প্রাথমিক অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত হওয়ায় সরকারি রাজস্ব আদায়ে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। একই সঙ্গে একই প্রাঙ্গণে থাকা প্রতিষ্ঠান দুটিকে কড়া নজরদারির মধ্যে রেখেছে কাস্টমস এক্সসাইজ ও ভ্যাট বিভাগ।

কারখানা দুটির অবস্থান সাভারের তেতুঁলঝোড়া ইউনিয়নের হেমায়েতপুর সংলগ্ন শ্যামপুরে।

প্রতিষ্ঠান দু’টি মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও সম্পূরক শুল্ক আরোপযোগ্য এবং মূসক অব্যাহতি প্রাপ্ত খাদ্যজাত দ্রব্য উৎপাদন ও সরবরাহকারী।

এনবিআরের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে বহুমুখী প্রতারণা, জালিয়াতি, উৎপাদন ও বিক্রি কম দেখানো, কাগজপত্রে মিথ্যা তথ্য প্রদান ও ঘোষণা প্রদানের মাধ্যমে মেসার্স প্যারাডাইজ ফুড প্রডাক্টস লিমিটেডে ৯ কোটি ৬১ লাখ ৩ হাজার ২’শ ৩১ টাকা ও প্রিন্স ফুড প্রডাক্টস লিমিটেডে ১ কোটি ৫৭ লাখ ৭ হাজার ৩শ’ ৪৮ টাকা ভ্যাট ফাঁকির বিষয়টি বাংলানিউজকে নিশ্চিত করেছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের ঢাকা পশ্চিমের কমিশনার হিসেবে মতিউর রহমান দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে জানতে পারেন- জালিয়াতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান দুটি বিপুল পরিমাণ সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে মূলত সরকারের টাকাতেই সম্পদের পাহাড় গড়ছে।

এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে শুরু হয় কারখানা দুটির কার্যক্রমের ওপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও নজরদারি।

রাজস্ব ফাঁকির বিষয়টি উদঘাটনে কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাটের টাঙ্গাইল বিভাগের সহকারী কমিশনার রাকিবুল হাসান ও সাভার বিভাগের সহকারী কমিশনার আকতার হোসেনের সমন্বয়ে গঠন করা হয় ১৮ সদস্যের টাক্সফোর্স।

দলটি আকস্মিকভাবে কারখানা দুটিতে অভিযান চালিয়ে দেখতে পায়- কারখানার ভ্যাট কর্মকর্তার কার্যালয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে লোক দেখানো চালান তৈরি হচ্ছে। আর গোপনে ভিন্ন আরেকটি কক্ষে সঠিক চালানের মাধ্যমে রাখা হচ্ছে কারখানা দুটির বিক্রিত পণ্যের আসল হিসাব।

কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাটের সাভার বিভাগের সহকারী কমিশনার আকতার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, একই প্রাঙ্গণে কারখানা দুটির অবস্থান হওয়ায় অভিন্ন ব্যক্তিরাই জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া চালান তৈরি করে ফাঁকি দিতেন কোটি টাকার রাজস্ব।

তিনি বলেন, অভিযানকালে আমরা দেখতে পাই- কারখানার ভ্যাট অফিসার লিটন উদ্দিন ও ইখতিয়ার ফাহিম শোয়েব হিসাব রক্ষক আরাফাতের যোগসাজসে একই নম্বরের একাধিক মূসক বইয়ের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ করছেন। প্রতিষ্ঠানটির মূসক ও বাণিজ্যিক দলিলাদি পরীক্ষা করে আমরা নিশ্চিত হই, প্যারালাল মূসক-১১ চালানের (একই নম্বরের একাধিক মূসক চালান বই) মাধ্যমে প্রতিদিনই গড়ে দুই তৃতীয়াংশ রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে প্রতিষ্ঠান দুটি।

এ সময় কারখানার ব্যবস্থাপক রাকিবুল ইসলাম, অপারেশন ম্যানেজার আকতার হোসেনসহ অন্যদের স্বাক্ষী ও উপস্থিতিতে কারখানার চলতি হিস‍াব, কম্পিউটারের সিপিইউ ও হার্ডডিক্স জব্দ করে নিয়ে যান কর্মকর্তারা।

পরে সেগুলো পর্যালোচনা করে আকাশ-পাতাল তারতম্য খুঁজে পান সংশ্লিষ্টরা।

পাশাপাশি হিসাবের বাইরে কাঁচামাল কিনে উৎপাদন এবং পরে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির বিষয়টি খতিয়ে দেখতে দফায় দফায় তল্লাশি অব্যাহত রেখেছেন কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কর্মকর্তারা।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে- কারখানার ব্যবস্থাপক রাকিবুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ভ্যাটের কোন কাজেই আমার সম্পৃক্ততা পাবেন না। আমি অত কাঁচা লোক নেই। এটা দেখভাল করেন অপারেশন ম্যানেজার আকতার হোসেনসহ কারখানার ভ্যাট অফিসাররা। তারাই ভালো বলতে পারবেন।
কারখানার ভ্যাট অফিসার লিটন উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, দেখতেই তো পাচ্ছেন, আমরা ছোট কর্মচারী। আমাদের যা দায়িত্ব দেয়া হয়, তাই পালন করি মাত্র।

জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ১২ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির বিষয়ে যোগাযোগ করা হয় প্রিন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, আমি নামাজ পড়ছি। এ ব্যাপারে পরে কথা বলবো।

তবে পরে তিনি আর ফোন ধরেননি।

প্রিন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান কাজী রুহুল আমিন তার কারখানায় কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কর্মকর্তাদের তল্লাশি ও গুরুত্বপূর্ণ নথি জব্দের বিষয়টি নিশ্চিত করে বাংলানিউজকে বলেন, তাদের কাজ তারা করেছে, আমাদের কাজ আমরা করছি। এতে আপনাদের কি!

তিনি বলেন, এমনিতেই কারখানা লসে চলছে। এভাবে অভিযান চালালে তো কারখানা চালু রাখা সম্ভব হবে না। গত তিন মাসে ব্যাংকের কিস্তির টাকা বকেয়া পড়েছে।

ভোক্তাদের কাছ থেকে আদায় করা ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা না দেওয়ার বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেশে ক’জনইবা শতভাগ ভ্যাট পরিশোধ করে!

কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের ঢাকা পশ্চিমের কমিশনার মতিউর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিষ্ঠান দুটির ভয়ংকর ও চাতুরিপূর্ণ ভ্যাট ফাঁকির ঘটনায় আমরা স্তম্ভিত ও বিস্মিত।

তিনি বলেন, ফাঁকি দেয়া সরকারি মূসক উদ্ধারে আটঘাঁট বেঁধেই নেমেছে এনবিআর। নতুন করে আর যাতে ভ্যাট ফাঁকি দিতে না পারে সে প্রচেষ্টার অংশ হিস‍াবে নজরদারিতে রাখতে একাধিক কর্মকর্তাকে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত রাখা হয়েছে কারখানাটিতে।

তিনি জানান, তারা মূল্য সংযোজন কর আইনের সংরক্ষণযোগ্য পুস্তকে (মূসক ১৭,১৮,১৯)যথাযথভাবে বিক্রয় তথ্য সংরক্ষণ ও সঠিক বিক্রয় অনুযায়ী প্রদেয় কর (মূসক ও সম্পূরক শুল্ক) পরিশোধ না করে অপকৌশল ও চাতুরির আশ্রয় নিয়ে জালিয়াতি করছে। একই নম্বরের একাধিক চালান বইয়ের মাধ্যমে উ‍ৎপাদিত দ্রব্য বিপণন করে ভ্যাট আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করছে।

মতিউর রহমান আরো বলেন, এখন আমাদের চ্যালেঞ্জই হচ্ছে ফাঁকি দেয়া বিপুল অংকের ভ্যাট উদ্ধার উদ্ধার করে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া।

বাংলাদেশ সময়: ১০৫৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০১৫
জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।