ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

ধ্বংসের পথে বায়রা লাইফ

সাঈদ শিপন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৬, ২০১৫
ধ্বংসের পথে বায়রা লাইফ

ঢাকা: অনিয়ম আর চরম অব্যবস্থাপনার কারণে বেসরকারি জীবন বিমা কোম্পানি বায়রা লাইফ ইন্স্যুরেন্স এখন ধ্বংসের পথে।
 
প্রতিবছর আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির প্রিমিয়াম আয়।

বছরে যে ব্যবসা করছে ব্যবস্থাপনা খাতেই ব্যয় হচ্ছে তার দুই গুণেরও বেশি।
 
আর বছরে নতুন পলিসি বিক্রির বিপরীতে তামাদি হচ্ছে অবিশ্বাস্য হারে। সর্বশেষ বছরে পলিসি বিক্রির বিপরীতে তামাদির হার দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩শ’ শতাংশের উপরে। অর্থাৎ ১০০টি পলিসি বিক্রি করলে তার বিপরীতে তামাদি হয়েছে ২ হাজার ৩০০টির উপরে!
 
প্রতিষ্ঠানটিতে এমন দুরবস্থা বিরাজ করছে যে, বছরের পর বছর খালি পড়ে আছে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) পদ। অথচ বিমা আইন অনুযায়ী ৩ মাসের বেশি সিইও পদ খালি রাখার বিধান নেই।
 
সম্প্রতি ব্যবসা সংক্রান্ত বিভিন্ন সূচক নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির তৈরি করা প্রতিবেদন থেকে এই বেহাল দশার চিত্র পাওয়া গেছে। ওই প্রতিবেদনে শফিকুল ইসলাম চলতি দায়িত্বে (সিসি) সিইও হিসেবে সই করেন। তবে আইন অনুযায়ী বিমা কোম্পানিতে সিইও পদে চলতি দায়িত্ব পালনের কোন সুযোগ নেই।
 
এদিকে দুর্বল আর্থিক অবস্থার কারণে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে পারেনি কোম্পানিটি। ফলে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে প্রতিদিন জরিমানা গুণতে হচ্ছে এই জীবন বিমা কোম্পানিটিকে। বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত না হওয়ার কারণে প্রতিদিন জরিমানা দিতে হচ্ছে ৫ হাজার টাকা। অর্থৎ বছরে ১৮ লাখ টাকা জরিমানা গুণতে হচ্ছে বায়রা লাইফকে।
 
প্রতিষ্ঠানটির এমন আর্থিক চিত্র দেখে একাধিক জীবন বিমা কোম্পানির সিইও বলেছেন, বায়রা লাইফের আয়-ব্যয়, তামাদি পলিসিসহ ব্যবসার অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য চিত্র দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা দুরূহ ব্যাপার।
 
গ্রাহকরা তাদের পাওনা ফিরে পাবেন কি না তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখতে ও গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে (আইডিআরএ)  তড়িৎ পদক্ষেপ নিতে হবে।
 
এদিকে আইডিআরএ’র একটি সূত্র জানিয়েছে, বায়রা লাইফের অর্থিক অবস্থা খতিয়ে দেখতে ২০১১ সালে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টস কোম্পানি এমজে আবেদিন অ্যান্ড কোম্পানিকে নিরীক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয় আইডিআরএ। তবে এরপর অদৃশ্য কারণে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আর কোন পদক্ষেপ নেয়নি আইডিআরএ।
 
এ বিষয়ে আইডিআরএ সদস্য কুদ্দুস খানের সঙ্গে একাধিক দিন যোগাযোগ করা হলেও নানা ব্যস্ততা দেখিয়ে তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। সর্বশেষ সোমবার (০৫ অক্টোবার) বিকালে ফোন দেওয়া হলে তিনি মিটিংয়ে আছেন জানিয়ে লাইন কেটে দেন।
 
আর এক সদস্য সুলতান উল আবেদীন মোল্লার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বায়রা লাইফ নিয়ে কোন মন্তব্য করতে চাননি তিনি। বাংলানিউজকে তিনি শুধু বলেন, বায়রা লাইফে অডিট নিয়োগ দেওয়া হয় আমার যোগদানের আগে। এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।
 
প্রিমিয়াম আয়:
সর্বশেষ ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় করেছে মাত্র ৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। ২০১৩ সালে যা ছিলো ৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা। ২০১২ সালে ৬ কোটি ২৭ লাখ, ২০১১ সালে ৫০ কোটি ৮৬ লাখ ও ২০১০ সালে ছিলো ৮৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০১০ সালের পর থেকেই অশঙ্কাজনক হারে প্রিমিয়াম আয় কমেছে। শেষ তিন বছরে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
 
ব্যবস্থাপনা ব্যয়:
২০১৪ সালে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের খাতে খরচ হয়েছে ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। তবে আইন অনুযায়ী বছরটিতে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা ৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা। অর্থাৎ আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত খরচ করা হয়েছে ৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। ২০১৩ সালে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের খাতে খরচ হয় ১৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। যা আইনি সীমার চেয়ে ৯ কোটি ১০ লাখ টাকা বেশি। ২০১২ সালে ব্যয় দেখা হয়েছে ১৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা- যা আইনি সীমার চেয়ে ৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বেশি। ২০১১ সালের ব্যয় ৫৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা- যা আইনি সীমার চেয়ে ৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকা বেশি। আর ২০১০ সালের ব্যয় ৮২ কোটি ২০ লাখ টাকা-যা আইনি সীমার চেয়ে ৯৮ লাখ টাকা বেশি।
 
নতুন ও তামাদি পলিসি:
২০১৪ সালে নতুন পলিসি বিক্রি হয়েছে ১৪ হাজার ৫৯৬টি। এর বিপরীতে বছরটিতে পলিসি তামাদি হয়েছে ৩ লাখ ৩৮ হাজার ৭৭০টি। ২০১৩ সালে নতুন পলিসি বিক্রি হয় ১০ হাজার ২৪১টি। এর বিপরীতে পলিসি তামাদি হয় ৩ লাখ ২৫ হাজার ৮৬৬টি। ২০১২ সালে ১২ হাজার ৯০০টি পলিসি বিক্রির বিপরীতে তামাদি হয় ৩ লাখ ১৭ হাজার ২৯৫টি। ২০১১ সালে ৪৮ হাজার ৬৮৬টি পলিসি বিক্রির বিপরীতে তামাদি হয় ২ লাখ ৯৩ হাজার ২৯৮টি। আর ২০১০ সালে ৫৩ হাজার ৫৭৯টি পলিসি বিক্রির বিপরীতে তামাদি হয় ২ লাখ ৪১ হাজার ৩৯৬টি।
 
বায়রা লাইফ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য:
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. আবুল বাশার বাংলানিউজকে বলেন, কোম্পানি থেকে গ্রাহকের টাকা ফিরে পেতে সমস্যা হবে না। কারণ গ্রাহকের টাকা কোম্পানিতে জমা আছে। তাছাড়া বিভিন্ন খাত থেকে আমরা যে মুনাফা পায় তা দিয়েই খরচ মেটাতে পারছি। আমাদের সামর্থ আছে বলেই যে ব্যবসা হয়েছে তার থেকে বেশি খরচ করতে পেরেছি। ফলে আমাদের কোম্পানিতে কোন সংকট নেই।
 
পুঁজিবাজারে তালিকাভ‍ুক্ত হতে না পারার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমরা মুনাফায় আছি। কিন্তু অ্যাকচুয়ারি প্রতিবেদন তৈরি করতে না পারার কারণে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে পারিনি।
 
তবে প্রিমিয়াম আয়, ব্যবস্থাপনা ব্যয় ও তামাদি পলিসির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি। এমনকি, কি কারণে অ্যাকচুয়ারি প্রতিবেদন তৈরি করতে পারেননি সে বিষয়েও কিছু বলেননি মো. আবুল বাশার।
 
বাংলাদেশ সময়: ১১১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৬, ২০১৫
এএসএস/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।