ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

হাজারীবাগে শঙ্কা-উৎকন্ঠা, আপিল করবেন ব্যবসায়ীরা

রহমান মাসুদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০১৭
হাজারীবাগে শঙ্কা-উৎকন্ঠা, আপিল করবেন ব্যবসায়ীরা হাজারীবাগ ট্যানারি কারখানায় কাজ চলছে ভিডিও: রহমান মাসুদ/ বাংলানিউজ

ঢাকা: উচ্চ আদালত অবিলম্বে হাজারীবাগের সকল ট্যানারি বন্ধ করতে সরকারকে যে নির্দেশ দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে আপিল করার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশন।

সাভারের চামড়া শিল্প নগরী এখনো প্রস্তত না হওয়ায় ব্যবসায়ীরা এ আপিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রায়ের কপি হাতে পেলেই আদালতে যাবেন তারা।


 
এদিকে গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ট্যানারি মালিকরা হাজারীবাগে কোন কাঁচা চামড়া না কেনার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, এখন পর্যন্ত তা মানা হচ্ছেনা। মঙ্গলবারও কয়েকটি ট্যানারিতে ঠেলাগাড়িতে করে রক্তমাখা কাঁচা চামড়া ঢুকতে দেখা গেছে।  

এলাকার প্রবেশমুখে টহরলতদের সঙ্গে অর্থের বিনিময়ে আপোসে এসব চামড়া হাজারিবাগে ঢুকছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। একাধিক ট্যানারিতে কাঁচা চামড়া ওয়েট ব্লু করতেও দেখা গেছে। যা পরিবেশের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর।  

হাজারীবাগ ট্যানারিতে ঢুকছে কাঁচা চামড়া, ছবি: সুমন শেখ/ বাংলানিউজ
এছাড়া সব ট্যানারিতেই অন্যান্য দিনের মতো চামড়া প্রক্রিয়াজাত করণের কাজ চলেছে স্বাভাবিক নিয়মেই। কোথাও সরকারের পক্ষ থেকে ট্যানারি বন্ধের কোন উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
 
ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন, ওয়েটব্লু’র কাজ তারা এরইমধ্যে সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে করতে শুরু করেছেন। দেশের সবচেয়ে বড় ৩৫টি ট্যানারি গত কোরবানির ঈদ থেকে সাভারে ওয়েট ব্লু’র কাজ শুরু করেছে। এখন হাজারীবাগে ওয়েট ব্লু বলতে গেলে নেই। যে কয়েকটি ট্যানারি এখানে এখনো আছে তারাও সাভারে যেতে প্রস্তুত। কিন্তু এরজন্য একটু সময় লাগবেই। হুট করে পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ লাইন কেটে দিলে পুরো সেক্টরই বিপদের মুখে পড়বে।
 
এ বিষয়ে হাজারীবাগের জনতা ট্যানিং ইন্ডাস্ট্রিজ এর চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বাংলানিউজকে বলেন, ট্যানারি শিল্প একটি ভারী শিল্প। এটা ক্ষুদ্র শিল্প নয়। এ শিল্পের জন্য গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের প্রয়োজন। সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে সরকার এখনো গ্যাস ও পানির লাইন যায়নি। গ্যাস ছাড়া ট্যানারি কিভাবে চালানো সম্ভব তা বোধগম্য নয়!
 
তিনি আরও বলেন, সাভারে এখন পর্যন্ত ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট চালু হয়নি। একটি কাঁচা চামড়ার ৮০ ভাগই ওয়েস্ট। এই ওয়েস্টের আবার ৮০ ভাগই সলিড ওয়েস্ট। সরকার সিটিপি করে দেওয়ার কথা বললেও এখন পর্যন্ত সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টর কোন ব্যবস্থা চালু করেনি। ওয়াটার ট্রিটমেন্টর ৪টি ইউনিটের একটি ইউনিট অপারেশনে গেলেও যে ৩৫টি ট্যানারি সেখানে ওয়েটব্লু’র কাজ শুরু করেছে তাই সামলাতে পারছেনা। এরইমধ্যে চামড়া শিল্প নগরীতে পানি জমতে শুরু করেছে। সেই পানি ধলেশ্বরী নদীতে পড়ে মাছ মারা যাওয়ায় এলাকাবাসী বিক্ষোভও করেছে। সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থা না থাকায় দুর্গন্ধে এলাকার বাতাস বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। ক্রোম ট্রিটমেন্ট প্লান্টের কোন উদ্যোগ না নিয়েই সরকার তড়িঘড়ি শুরু করেছে, অভিযোগ এই ব্যবসায়ীর।
হাজারীবাগ ট্যানারির একটি দৃশ্য, ছবি: সুমন শেখ/ বাংলানিউজ 
আজাদ আরও বলেন, মন্ত্রী আমাদের মার্চ পর্যন্ত সময় দিয়েছিলেন। আমরা জুন পর্যন্ত সময় চেয়েছিলাম। কিন্তু এরইমধ্যে আদালতের রায়ে সব কিছু অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।
 
অন্যদিকে কালাম ব্রাদার্স ট্যানারি লিমিটেডের পরিচালক  শহিদুল খায়ের বাংলানিউজকে বলেন, আমরা সাভারে যেতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু সরকার এখন পর্যন্ত আমাদের বরাদ্দকৃত জমির দলিল হস্তান্তর করেনি। হাজারীবাগে আমাদের ব্যাংক লোন আছে। সাভারের জমির দলিল পেলে আমরা মর্গেজ রেখে ব্যাংক থেকে টাকা নিতে পারতাম। এটা আমাদের জন্য বড় সাপোর্ট হতো। কিন্তু তার আগে আমরা রায়ের কপি হাতে পেতে চাই। কপি পেলে আমরা আদালতে গিয়ে আপিল করবো। আপিল খারিজ হলে আমরা সাভারে চলে যাবো।
 
তিনি বলেন, যাওয়ার আগে সাভারে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তার আগে ট্যানারি বন্ধ করে দিলে ব্যাংক লোন শোধ করা যাবেনা। শ্রমিকদের বেতন দিতে পারবোনা।
 
এদিকে চোখে অন্ধকার দেখছেন ট্যানারি শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল কেমিক্যাল ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। হাজারীবাগের সবচেয়ে বড় ক্যামিকেল ব্যবসায়ী হাজী সিরাজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, একটি চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে কম হলেও ১০০ প্রকার কেমিক্যালের প্রয়োজন হয়। চামড়া শিল্প পল্লী গড়ে উঠলেও সরকার এই পল্লীতে সহায়ক ব্যবসায়ীদের জন্য প্লট বরাদ্দ করেনি। একটি কাচাঁ চামড়ার দাম দুই হাজার টাকা হলে তা পাঁকাতে আরো দুই হাজার টাকার কেমিক্যাল প্রয়োজন হয়।
 
তিনি বলেন, সব ট্যানারিতে আমাদের কোটি কোটি টাকার বকেয়া পাওনা রয়েছে। বলতে গেলে আমরাই ট্যনারি চালাই। এখন এই বুড়ো বয়সে এসে চোখে শর্ষের ফুল দেখছি। ট্যানারি বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের ব্যবসাও বন্ধ হয়ে যাবে। আমরাও আমাদের পাওনা ফিরে পাবো না।
 
অন্যদিকে ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারাণ সম্পাদক আব্দুল মালেক বলেন, ট্যানারি একটি ঝুকিঁপূর্ণ ভারী শিল্প। এই শিল্পে কাজ করতে গেলে যে কোন সময়েই  দুর্ঘটনার আশংকা থাকে। কিন্তু সাভারের চামড়া শিল্পে শ্রমিকদের প্রাথমিক চিকিৎসার ও কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। নেই কোন বাসস্থান বা অন্য কোন ব্যবস্থাও। এখন পর্যন্ত যে কয়টি ট্যানারি সেখানে কাজ করা শুরু করেছে সেখানে প্রতিদিন ঢাকা থেকে গিয়ে কাজ করে আবার ফিরতে হয়। এমন অবস্থায় ট্যানারি বন্ধ করে দিলে চামড়া শিল্পে তার প্রভাব পড়বে।
 
আবার কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলাম জানান,  ওয়েট ব্লু টা এখনই চামড়া শিল্প পল্লীতে চলে যাওয়া উচিত। তবে ফিনিশড লেদারকে আরো সময় দেওয়া উচিত। তবে এটা মনে রাখা দরকার সরকার কিন্তু অনেক সময় দিয়েছে। তবে সাভারে কারখানা করার মতো পরিবেশ সরকার এখনো তৈরি করতে পারেনি।
কাজ চলছে হাজারীবাগ ট্যানারিতে, ছবি: সুমন শেখ/ বাংলানিউজ 
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব ফুটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউট এর লেদার টেকনোলজি’র বিভাগের প্রধান ও চামড়া শিল্প নগরীর কনসাল্টেন্ট অমিত কান্তি দেব বাংলানিউজকে বলেন,  সরকারের প্রধান ভুল হয়েছে ট্যানারি শিল্পর জাত চিনতে। এটা একটি ভারি ও টেকনোলজি নির্ভর শিল্প হলেও সরকার চামড়া নগরী করার দায়িত্ব দিয়েছিল বাংলাদেশ ক্ষুদ্র শিল্প কর্পোরেশনকে (বিসিকি)।
 
তিনি বলেন, সরকার এখনো সিটিপি চালু করতে পারেনি। যদিও তা করার কাজ চলছে। কিন্তু সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টর কোন ব্যবস্থা রাখেনি। তারা সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টর জন্য চার কোটি টাকা বরাদ্ধ রেখেছে ইয়ার্ড তৈরির জন্য। এতে হাজারীবাগ থেকে যে জন্য ট্যানারি হস্তান্তর করা হচ্ছে, সেই পরিবেশের কোন উপকার হবেনা। কারণ ট্যানারি বর্জ্যের ৮০ ভাগই সলিড ওয়েস্ট। এর ক্যামিকেল, লবন মাটি ও পানিকে দুষণ করবে। দুর্ঘন্ধে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটবে।

তবে ব্যবসা ধরে রাখতে ব্যবসায়ীদের এখনই সেখানে চলে যেতে হবে। কেননা বিদেশি ক্রেতারা বাংলদেশি চামড়া নিয়ে দোটানায় আছে। যে কারণে চামড়া রফতানি কমে গেছে। সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে ট্যানারি গেলে তারা আবার বাংলাদেশে ফিরে আসবে।

আরও পড়ুন..
** ‘ভুল তথ্যে আদালতের রায়’, দাবি ট্যানারি মালিকদের

বাংলাদেশ সময় ০৯২৭ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১৭
আরএম/এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।