ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

‘ভুল তথ্যে আদালতের রায়’, দাবি ট্যানারি মালিকদের

রহমান মাসুদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২০৩ ঘণ্টা, মার্চ ৯, ২০১৭
‘ভুল তথ্যে আদালতের রায়’, দাবি ট্যানারি মালিকদের হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প/ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: ট্যানারি নিয়ে কিছু ভুল তথ্য আদালতের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে দাবি ট্যানারি মালিকদের। সে কারণেই হঠাৎ করে আদালত এমন রায় দিয়েছেন যাতে বিপাকে পড়েছেন এই মালিকরা।

আর এ জন্য তারা দোষারোপ করছেন একটি পরিবেশবাদী বেসরকারি সংস্থা ও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে।

হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সাভার শিল্প নগরে সরিয়ে নেওয়া নিয়েই এই জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি তাদের।

মালিকরা বলছেন, ভুল তথ্যের ভিত্তিতেই হঠাৎ করে ট্যানারিতে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্নে উচ্চ আদালতের রায় এসেছে।

মালিকরা সরাসরি আঙ্গুল তুলছেন সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয় ও রিট আবেদনকারী পক্ষ বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)’র দিকে।
হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প/ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমএকাধিক মালিক, ও মালিক পক্ষের অ্যাসোসিয়েশন নেতাদের কয়েকজন বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, আদালতের রায়ের কপি হাতে পেলে তারা আপিল বিভাগের শরণাপন্ন হবেন। আর সে সুযোগে তারা আদালতকে বিষয়টি অবহিত করবেন।

আপিলের মাধ্যমে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরের জন্য সময়ও চাইবেন মালিকরা।
 
ব্যবসায়ীরা বলছেন, যেসব তথ্য ও যুক্তির ভিত্তিতে তড়িঘড়ি করে এই শিল্পের বিরুদ্ধে রায় আনা হয়েছে তার বেশির ভাগই মিথ্যা।
 
তারা বলছেন, সাভারের চামড়া শিল্প নগরে যেতে তাদের কোন আপত্তি নেই। কিন্তু তার আগে সেখানকার পরিবেশ ঠিক করতে হবে। চামড়া শিল্পের অত্যাবশকীয় গ্যাস সংযোগ স্থাপন করতে হবে। সিইটিপি, ক্রোম ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট ইয়ার্ড তৈরি না করলে হাজারিবাগের মতো অবস্থা হবে হেমায়েতপুরেরও। বুড়িগঙ্গার পরিনতি নিতে হবে ধলেশ্বরী ও তুরাগকে। অন্যদিকে কারখানা বন্ধ ও উৎপাদন ব্যাহত হলে এ সম্ভাবনাময় খাতের পরিনতি হবে করুণ।
হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প/ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমপ্রস্তুতি ছাড়া এমন স্থানান্তরে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। ধস নামবে সহযোগি আরো ১০টি উপখাতে। বিদেশি মুদ্রা আয়ের ও একটি সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটবে, দাবি এই মালিকদের।
 
তারা আরো কিছুটা সময় নিয়ে সাভারের চামড়া শিল্প নগরকে প্রকৃত শিল্প নগরীতে রূপ দিয়ে যত্নের সঙ্গে পরিকল্পনা মাফিক ট্যানারি স্থানান্তরের দাবি জানিয়েছেন।
মালিকরা বলছেন, এজন্য প্রয়োজনে আদালতকে সব ধরেনর তথ্য উপাত্ত সরবরাহ ও সরকারকে সকল সহযোগিতা করতে ও তারা প্রস্তুত।
 
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ১৯৯৪ সালের মামলার প্রেক্ষিতে ২০০৯ সালে আদালত তার পর্যবেক্ষনে বলেছিলেন, হাজারীবাগ থেকে সকল ট্যানারি স্থানান্তর করতে হবে।

এজন্য আদালত ট্যানারির গ্যাস, বিদ্যুত ও পানির লাইন কাটার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমরা তখন এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালতে একটি আবেদন করেছিলাম। তাতে ট্যানারি স্থানান্তরের প্রতিবন্ধকতা গুলো তুলে ধরেছিলাম।
 
শাহীন আহমেদ বলেন, যে যুক্তিতে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরিয়ে সাভারের হেমায়েতপুরে নেওয়া হচ্ছে, তার সঙ্গে আমাদের কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু সে যুক্তি কার্যকর হবে না যদি প্রস্তুতি ছাড়া এই স্থানান্তর করা হয়।
হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প/ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমএই ব্যবসায়ী নেতা বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করে বলেন, পরিবেশকে প্রাধান্য দিয়ে সংস্থাটি বলছে ট্যানারি পরিবেশ দুষন করছে এবং বুড়িগঙ্গা দুষনের জন্য ট্যানারিই ৬০ ভাগ দায়ী।

তাদের যুক্তিতে এও বলা হয়েছিলো হাজারীবাগে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নেই, সিইটিপি নেই, ডাম্পিং ইয়ার্ড নেই।

যুক্তি যদি তাই হয়, তাহলে সাভারের চামড়া শিল্প পল্লীতেও এখনো সিইটিপি তৈরি হয়নি। সেখানে ড্রেনেজ ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। হাজারীবাগে যেখানে বড় বড় ড্রেনেই পানি উপচে পড়ে সেখানে, সাভারে ১৮ ইঞ্চি পাইপ দিয়ে ড্রেনেজ চালু করা হয়েছে। এরইমধ্যে যে ৩০টি ট্যানারি ওয়েট ব্লু শুরু করেছে, তাতেই ওভার ফ্লো হচ্ছে। সেই পানি ধলেশ্বরীতে পড়ে মাছ মারা যাচ্ছে। সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট ইয়ার্ডের কাজ ও শুরু হয়নি। এরই মধ্যে সেখানে সলিড ওয়েস্টে এলাকার পরিবেশ দুষণ হচ্ছে। ক্রোম ট্রিটমেন্টের প্লান্টের কাজ এগিয়েছে মোটে ৬০ ভাগ। ফলে স্থানটি পুরোপুরি স্থানান্তরের জন্য প্রস্তুত নয়।

এই অবস্থায় পুরো ট্যানারি স্থানান্তর হলে হীতে-বিপরীতই হবে, এমন মত দিয়ে এই ট্যানারি মালিক বলেন, বিষয়গুলো আদালতের কাছে লুকোনো হয়েছে বলেই আদালত হঠাৎ করে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে।

তিনি বলেন, ক্রাস্ট লেদারের জন্য অবশ্যম্ভাবী হলো গ্যাস সংযোগ। এখন পর্যন্ত গ্যাস সংযোগের কোন ব্যবস্থা নেই। আমাদের যে জমি দেওয়া হয়েছে, সে জমির কোন দলিলও হস্তান্তর করা হয়নি।
 হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প/ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
‘অথচ শিল্প সচিব আদালতকে জানিয়েছেন, সাভারের চামড়া শিল্প নগরী সম্পূর্ণ প্রস্তুত। বেলা’ও সে কথায় সায় দিয়ে বলেছে, ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার জন্য সাভারে যেতে চায়না। ’ এমন কথা দাবি করে ট্যানারি সমিতির সভাপতি বলেন, এই ভুল ও মিথ্যা তথ্য উপস্থাপনের কারণেই আদালত গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ট্যানারি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন।
 
তিনি বলেন, শিল্প মন্ত্রণালয়ের আইনজীবী আদালতকে ভুল বুঝিয়েছেন বলেও মত দেন তিনি।
 
এদিকে, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক সূজাউল করিম নিপুও একই অভিযোগ করেন। সাভারকে প্রস্তুত না করে হাজারীবাগ বন্ধ করা হলে চামড়া শিল্পের পরিনতি হবে ভয়াবহ, মত এই ব্যবসায়ী নেতার।
 
তবে কোনও কোনও ব্যবসায়ী দোষ নিজেদের কাঁধেও নিচ্ছেন। কালাম ব্রাদার্স ট্যানারির নির্বাহি পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বাংলানিউজকে বলেন, ভুল আমাদেরই। আমরা আদালতকে আমাদের সমস্যার কথা বোঝাতে পারিনি। যে কারণে রায় আমাদের বিপক্ষে গেছে।
 
পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা)’র করা এর রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে গত ৬ মার্চ হাজারীবাগ থেকে যেসব ট্যানারি সাভারে সরিয়ে নেওয়া হয়নি অবিলম্বে বন্ধ করে কারখানা গুলোর বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার আদেশ দেন
হাইকোর্ট।

পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে আদালতের এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। আর এ কাজে সহায়তার জন্য স্বরাষ্ট্র সচিব, শিল্প সচিব ও আইজিপিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
হাজারীবাগের ঠেলায় করে ট্যানারি শিল্প আনা-নেওয়া করছে শ্রমিকরা/ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমমালিক পক্ষের এসব অভিযোগ নিয়ে বাংলানিউজের কথা হয় বেলার নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বা বেলার পক্ষ থেকে কোন ভুল তথ্য দেওয়া হয়নি। আদালতকেও ভুল বোঝানোর কোনও সুযোগ নেই।

সাভারে যদি কিছু প্রস্তুত নাই থাকে গত অক্টোবরে কেনো মালিকপক্ষ মার্চ পর্যন্ত সময় নিলো? তারা তখন কেনো বলেনি, আমাদের এই এই সমস্যা আছে, আমরা যেতে পারবো না। তাদের ৪৭টি প্রতিষ্ঠান যখন সেখানে গিয়ে কাজ করা শুরু করেছে তখন বাকিদের সমস্যা কি? বলেন তিনি।
 
সাভার এখনো অসম্পূর্ণ ও অপ্রস্তুত সে কথা স্বীকার করে নিয়ে এই পরিবেশবাদী আইনবিদ বলেন, ‘তাও এই মালিকপক্ষের কারসাজিতে কিংবা তাদের তাদের ইচ্ছাতেই হচ্ছে না। যাতে তারা অজুহাত দেখাতে পারেন। ’

মালিকপক্ষকে এইসব কূটতর্ক না করে সোজা আদালতে গিয়ে তাদের সমস্যা তুলে ধরার পরামর্শ দেনে রিজওয়ানা হাসান।

‘তারা আদালতে যাচ্ছেন না কেনো? তারা সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করছেন না কেনো?’ এসব প্রশ্নও তোলেন তিনি।

এ বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়োজিত আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তার মন্তব্য পেলে এই প্রতিবেদনে সংযুক্ত করা হবে।

** হাজারীবাগে শঙ্কা-উৎকন্ঠা, আপিল করবেন ব্যবসায়ীরা

বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, মার্চ ০৯, ২০১৭
আরএম/এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।