তবে প্রথমদিকে তিনি অন্যের কোম্পানিতে শ্রম দিতেন, এখন কাজ করেন নিজের ট্যানারিতে। চামড়ার ওয়েট ব্লু করা থেকে শুরু করে সব ধরণের কাজই তিনি করেন শ্রমিকদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে।
আগে তার ট্যানারি ছিল হাজারীবাগে সাড়ে চার কাঠা জমিতে। গত ডিসেম্বরে সাভারের হেমাতেপুরের চামড়া শিল্প পল্লীতে স্থানান্তরিত হয়েছে। নতুন কারখানাটিও খুব বড় নয়। মাত্র ১০ হাজার স্কয়ার ফুট আয়তনের।
বয়স হয়েছে আকতারুজ্জামানের। তবু কাজ করতে তার অলস্য লাগে না। প্রতিদিন সকালেই হাজারীবাগ থেকে বাসে করে চলে আসেন নতুন ঠিকানায়। শ্রমিকের এই জীবনে তিনি কখনোই নিজেকে স্বাচ্ছন্দ্য আর প্রতিপত্তির কাছে সমর্পণ করেননি।
১৯৯০ সালে নিজে ট্যানারির মালিক হয়েছেন, কিন্তু নিজেকে মালিক ভাবেননি কখনোই। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তরের সময় গ্রামের কিছু জমি বিক্রি করেছেন, বন্ধুদের কাছ থেকে কিছু ধার-দেনাও করেছেন। কিন্তু ব্যাংকে হাত পাতেননি সদা হাস্যচ্ছ্বল এই মানুষটি।
রক্ত ঘাম করে গড়ে তোলা আহসান হাবীব এন্ড ব্রাদার্স নামের ট্যানারিতে দাঁড়িয়ে যাপিত জীবনে অর্জিত লড়াইয়ের গল্প যখন তিনি বাংলানিউজকে বলছিলেন, তখন তাকে চিরসুখীদেরই একজন মনে হচ্ছিলো।
বলেন, ১৯৬৪ সালে যখন ঢাকায় এসেই কাজ নেই হাজারীবাগের মিলন ট্যানারিতে। চামড়ার ওয়েট ব্লু’র কাজ করতাম। এখানে কাজ করি চার বছর। তারপর আট বছর কালু লেদার্সে। এরপর আরো সাত বছর কাজ করি ইউসুফ লেদারে। এক সময় ট্যানারির চাকরির সাথে সাথে শুরু করি এ সম্পর্কিত ছোটখাটো ব্যবসা।
আকতারুজ্জামান বলেন, এভাবে কাজ করতে করতেই ১৯৯০ সালে ইউসুফ লেদারের মালিকের সহায়তায় নিজের জমানো টাকায় মাদ্রাজি ট্যানারির সাড়ে চার কাঠা জমি কিনে ফেলি। সেই জমিতে গড়ে তুলি বড় ছেলের নামে ‘আহসান হাবীব এন্ড ব্রাদার্স’ নামের ট্যানারি। চারটি ওয়েট ব্লু -ড্রামের মাধ্যমে এ ট্যানারির যাত্রা শুরু হয়। যা এখন সাভারের চামড়া শিল্প পল্লীতে নিয়ে এসেছি। এখানেও এখন চারটি ড্রামেই চামড়া প্রক্রিয়া শুরু করেছি। ভবনের কাজ শেষে হলে আরো ড্রাম বসানো হবে। এই ভবন করতে তিন বছর সময় লেগেছে। কারখানা ভবনের নীচতলা কোনো রকম কাজ চালানোর মতো করা হলেও দোতলার কাজ এখনো শেষ হয়নি।
নিজের সম্পর্কে বলেন, আমি একটি কোম্পানির মালিক, কিন্তু আমাকে কেউ মালিক বলে না। মালিকের মতো আমিও কারো সঙ্গে চলি না। প্রতিদিনই হাজারীবাগ থেকে বাসে করে এখানে আসি। শ্রমিকদের সঙ্গে সব ধরণের কাজ করি। ওরাও আমাকে মালিক ভাবে না, আমিও ওদের শ্রমিক ভাবি না। আমরা সবাই সহকর্মী।
আকতারুজ্জামান বলছিলেন, এ কাজে অনেক কষ্ট। কেমিকেল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে অনেক অঘটন ঘটে। তবু হাল ছাড়িনি। ট্যানারির সব কাজই পারি, সব কাজই করি। এই কাজ করে আমি গাড়ি, বাড়ি, কারখানার মালিক হয়েছি। তাই কাজকে অবহেলা করি না।
স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে আকতারুজ্জামানের সংসার। পরিবার নিয়ে হাজারীবাগের নিজের বাড়িতেই থাকেন। বড় ছেলে আহসান হাবীব তথ্য প্রযুক্তিতে স্নাতক শেষ করে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে সুইডেন গেছেন। ছোট ছেলে মিজানুর রহমান ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ পাস অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে এখন বাবার ব্যবসায় সহযোগিতা করছেন।
আকতারুজ্জামান বলেন, বাইরের সব কাজই ছোট ছেলেকে দিয়ে করাচ্ছি। এর পাশাপাশি সে হাজারীবাগে একটি ফুটওয়্যার কারখানা ও শো রুম করেছে। ব্যবসা শিখছে। এক সময় ওরাই ব্যবসা বড় করবে।
গল্পে গল্পে তিনি বলে যান তার সংগ্রামী জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাতের কথা। অর্জন আর আনন্দের কথাও।
সাভারের চামড়া শিল্পপল্লী নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। তিনি ভাবেন, একদিন এই চামড়া শিল্পপল্লী দেশের চামড়া শিল্পের চেহারাই পাল্টে দেবে। উন্মোচন করবে রফতানির নতুন দিগন্ত।
তবে হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তর নিয়ে সরকার, মালিকদের মধ্যে যে দড়ি টানাটনি চলছে, তাতে তিনি কিছুটা বিব্রত। এজন্য দুই পক্ষই দায়ী মনে করেন এই চামড়া কারখানা মালিক।
বাংলাদেশ সময় ০২০৫ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১৭
আরএম/এমএমকে