বাংলানিউজের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হাজারীবাগের এইসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর প্রচলিত নাম ‘কমার্শিয়াল এক্সপোর্টার’। প্রায় শতাধিক ট্যানারি ভাড়া নিয়ে এরা বন্ধ হতে যাওয়া ট্যানারিগুলোকে সচল রেখেছেন।
সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণদাড়া চামড়া শিল্পপল্লির প্লট বিতরণ হয়েছে হাজারিবাগের ট্যানারি প্লটের বিপরীতে। তাই হাজারীবাগের ট্যানারি মালিকরাই কেবল সেখানে প্লট পেয়েছেন। তবে যে শ’খানেক ট্যানারি মালিক এতোদিন হাজারিবাগে ট্যানারি ভাড়া দিয়ে চলেছেন, তারা প্লট পেলেও প্লটে কারখানা গড়তে পারেননি টাকার অভাবে। আবার সেই সব ট্যানারির ভাড়াটিয়া হিসেবে যারা চামড়াশিল্পকে চালিয়ে নিচ্ছিলেন সেইসব কমার্শিয়াল এক্সপোর্টার ট্যানারির মালিক না হওয়ায় সাভারে প্লট পাননি। একারণে তারা ব্যবসা বন্ধের দারগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছেন।
হাজারিবাগের একটি পুরনো চামড়া প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান কালু লেদার্স। প্রায় ২০জন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী গত ২০ বছর ধরে এই ট্যানারিটি ভাড়া চালু রেখেছেন। এই ব্যবসায়ীরা বড় রপ্তানিকারকদের জন্য চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য তৈরির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্যও তৈরি করছেন নানা চামড়াজাত পণ্য। সেইসঙ্গে সামরিক, আধা সামরিক ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য বুট, জুতা, বেল্টসহ নানা পণ্য।
‘কমার্শিয়াল এক্সপোর্টার’ লুৎফর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘এতোদিন কম পুঁজির মালিকরা ভাড়া তুলেছেন আর খেয়েছেন। প্লট পেলেও সাভারের কারখানা করার মতো টাকা তাদের নেই। সেখানে যে ট্যানারিগুলো উৎপাদন পর্যায়ে রয়েছে, সেগুলো বড় কোম্পানি। তাদের কারখানা তারা কমার্শিয়াল এক্সপোর্টারদের কাছে বা ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের কাছে ভাড়া দেবেন না। প্লট না থাকায় আমরা ট্যানারি করতে পারছি না। ফলে ব্যবসা হারানোর শঙ্কা আমাদের ঘিরে ধরেছে। ’
অন্য এক ব্যবসায়ী বলেন, হাজারিবাগে তো ট্যানারিওয়ালারা ব্যবসা করেন না। ব্যবসা করেন যৌথভাবে ট্যানারি ভাড়া নেওয়া কমার্শিয়াল ব্যবসায়ীরা। অথচ তারা সাভারে জমি পাননি।
বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার অ্যান্ড লেদার গুডস এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সদস্য হাজী আখতারুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, হাজারিবাগে ১৯৪টি ট্যানারি আছে। এদের কয়েকটি বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি ট্যানারিগুলোর ১৫৫ জন মালিককে সাভারে প্লট দেওয়া হয়েছে। বাকিরা প্লট পাননি। আবার যারা প্লট পেয়েছেন, তাদের মধ্যে ৩৫ থেকে ৪০জন ট্যানারিমালিক নিজেরা সরাসরি চামড়া ব্যবসায় জড়িত। বাকিরা ট্যানারি ভাড়া নিয়ে চালান।
তিনি জানান, এইসব ভাড়া দেওয়া ট্যানারির ওপর ভিত্তি করে দেশে ১৫৪টি জুতা রফতানি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আবার এইসব কমার্শিয়াল এক্সপোর্টাররাই দেশের আভ্যন্তরীণ সব চাহিদা পূরণ করে থাকেন।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, প্রায় ২০জন ট্যানারিমালিক সাভারে প্লট পাননি। আবার কয়েকজন ট্যানারি মালিক আদালতে মামলা থাকায় প্লট পাননি। হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তর হওয়ার পর এদের অনেকেই ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়বেন।
তিনি বলেন, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ‘কমার্শিয়াল এক্সপোর্টাররা’। সাভারে সব ধরনের কমার্শিয়াল এক্সপোর্টারদের জন্যই একটি করে বড় প্লট ছিল। এ প্লটটি ক্ষমতাবানরা খেয়ে ফেলেছেন। তবে চামড়া শিল্পপল্লির দ্বিতীয় ফেজে তাদের প্লট দেওয়া হবে বলে শুনেছি। প্রথম পর্ব শেষ হওয়ার পর আরো দুইশ একর জমিতে দ্বিতীয় ফেজ শুরু হবে। এখন জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্যমতে, নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যার পাড় থেকে ট্যানারিশিল্প ঢাকার হাজারিবাগে স্থানান্তর হয়েছিল ভারতভাগের পরপরই। পাকিস্তান সরকারের নেয়া সে উদ্যোগে হাজারিবাগে ট্যানারি প্লট ছিলো ১৯৫টি। সময়ের বিবর্তনে ও নানা ঘাত প্রতিঘাতে এই ট্যানারিমালিকদের সবাই আর এ ব্যবসায় টিকতে পারেননি। তাই বলে বন্ধ হয়নি তাদের ট্যানারিগুলো। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এসে বন্ধ হওয়া ট্যানারিগুলো ভাড়া নিয়ে এ ব্যবসাকে চালু রেখেছিলেন। হাজারীবাগে কয়েকটি বড় ট্যানারি ছাড়া চামড়া ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাই। অথচ এখন তারা পড়েছেন অস্তিত্ব সংকটে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৬ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০১৭
আরএম/জেএম