অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারত থেকে বেআইনিভাবে আসা পোনার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন চাষিরা। এসব পোনায় বিভিন্ন ধরনের ভেজাল রয়েছে।
খুলনার ডুমুরিয়া, পাইকগাছা, বাগেরহাটের ফকিরহাটের ফলতিতা, রামপালের ফয়লা, মোংলা, মোড়েলগঞ্জ, শরণখোলা বিভিন্ন পোনার বাজারে ভারত থেকে চোরাইপথে প্রচুর পোনা আসে। সেই পোনাতেই সয়লাব এলাকা। দেশি হ্যাচারির পোনাও ভারতীয় পোনার কাছে টিকতে পারছে না।
অভিযোগ রয়েছে, হ্যাচারি মালিকরা প্রতারণা করে ভারতীয় পোনাকে দেশের নদ-নদীর মাছ বলে চিংড়ি চাষিদের কাছে বিক্রি করছেন। বেশির ভাগ পোনা ঘেরে ছাড়ার পরেই মারা যাচ্ছে। আবার পোনা ছাড়তে হচ্ছে। এর ফলে যেমন উৎপাদন খরচ বাড়ছে, তেমনি উৎপাদনও কম হচ্ছে। জানা যায়, খুলনার বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় দেশের সবচেয়ে বেশি গলদা ও বাগদা চিংড়ির চাষ হয়। এসব এলাকায় প্রতিবছর কয়েক কোটি রেণু পোনার চাহিদা থাকে। কিন্তু প্রাকৃতিক উৎস যেমন নদ-নদী, খাল-বিল থেকে রেণু পোনা আহরণ নিষিদ্ধ থাকায় হ্যাচারির রেণু পোনার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন চাষিরা। চাষিদের সঙ্গে প্রতারণা করে ভারতীয় অপুষ্ট ও গুণগত মানহীন পোনা তুলে দেন অনেক হ্যাচারি মালিক ও কিছু ব্যবসায়ী।
বাগেরহাট জেলার মোংলার চিলা ইউনিয়নের সুন্দরতলা গ্রামের ঘের মালিক বিজন বৈদ্য বাংলানিউজকে বলেন, প্রাকৃতিক উৎস থেকে রেণু পোনা আহরণ সরকারিভাবে নিষিদ্ধ। এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে আসা অপুষ্ট রেণু পোনা হ্যাচারির বলে চাষিদের কাছে বিক্রি করেন। যা ঘেরে ফেলার পর ভাইরাসসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মরে যায়। ফলে কাঙ্ক্ষিত চিংড়ি উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন মৎসচাষিরা।
তিনি জানান, নদী থেকে মাছের পোনা বা রেণু ধরা নিষিদ্ধ। তারপরও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও কোস্টগার্ডের চোখ ফাঁকি দিয়ে সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদী থেকে রেণু আহরণ করেন এ অঞ্চলের নদ-নদী পাড়ের হাজার হাজার সহায়-সম্বলহীন গরিব মানুষ।
বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় পোনা ধরেই এসব মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয়। এসব মাছের পোনা মানে ভালো হলেও ভারতীয় রেণুর কাছে মার খেয়ে যাচ্ছে।
বিজন বলেন, এ অঞ্চলে দেশীয় বাগদা রেণু পোনার হাজার এখন বিক্রি হচ্ছে ৬শ টাকা। যা গত বছর ছিলো এক হাজার থেকে ১২শ টাকা। গলদার রেণু পোনা এবার হাজার বিক্রি হয়েছে ১৫০০-২০০০ টাকা। যা গত বছর ছিলো ৩০০০-৩৫০০টাকা।
রামপালের ফয়লা বাজারের চিংড়ির পোনা ব্যবসায়ী কালাম শেখ বলেন, ভারত থেকে অবৈধভাবে বাগদা ও গলদা রেণু এনে পোনা উৎপাদন ও বাজারজাত করছেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। সাতক্ষীরার সীমান্ত থেকে এসব রেণু এনে খুলনার ডুমুরিয়া, ফকিরহাটের ফলতিতা, রামপালের ফয়লা, মোংলাসহ বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন। এসব পোনা নিম্নমানের। দামে কম হওয়ায় না বুঝে অনেক চিংড়ি চাষি ঘেরে এ মাছ ছাড়েন। তিনি বলেন, প্রাকৃতিক উৎস থেকে আহরিত রেণুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। এগুলো অনেক দিন বাঁচে, আকারেও বড় হয় এবং গুণগত মানও ভালো। ফলে উৎপাদন হয় ভালো। কিন্তু ভারতীয় পোনার গুণগত মান খারাপ হওয়ায় ঘেরে চিংড়ি মারা যায়।
খুলনা জেলা হ্যাচারি পোনা ব্যবসায়ী সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি জি এম ইকরামুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ভারত থেকে অবৈধভাবে বাগদা ও গলদার রেণু এনে পোনা উৎপাদন ও বাজারজাত করছেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। এর মধ্যে বেশ কিছু হ্যাচারী মালিকও রয়েছেন। এসব মাছ দেখতে খুবই সুন্দর। কম দামে অপুষ্ট ও গুণগত মানহীন এসব পোনা চাষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাষিরা।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, সাতক্ষীরার সীমান্ত থেকে ভারতীয় পোনা তালা উপজেলার খেশরা ইউনিয়নের বালিয়া ব্রিজ ও পাইকগাছার শিববাড়ি ব্রিজ পার হয়ে মাইক্রোবাসে গভীর রাতে খুলনায় প্রবেশ করে।
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অন্যতম সহায়ক ভূমিকা পালনকারী চিংড়ি শিল্প। সে কারণেই সরকারকে এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত বলে মনে করছেন ঘের ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা।
খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবু ছাইদ বাংলানিউজকে বলেন, অবৈধভাবে যারা ভারতীয় চিংড়ি পোনা আনেন তাদের বিরুদ্ধে কোস্টগার্ডের সঙ্গে সমন্বয় করে বিভিন্ন সময় অভিযান চালানো হয়। আটক ও জরিমানা করা হয় তাদের।
তিনি চিংড়ি চাষিদের দাম কম দেখে ভারতীয় পোনা না কেনার পরামর্শ দেন।
খুলনা জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) এস এম শফিউল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, চোরাইপথে যারা ভারত থেকে পোনা আনে তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ঘের মালিকরা না বুঝে সস্তা পেয়ে এসব পোনা কিনে পরে দেখে চিংড়ি মরে যায়। এতে তারা অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হন। চোরাকারবারীর সঙ্গে জড়িতদের কঠোর হাতে দমন করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০১৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৯
এমআরএম/এএটি