রাজশাহী: ‘জমির প্রকৃতি পরিবর্তন করা যাবে না’— এমন সরকারি নির্দেশ থাকলেও রাজশাহীর দুর্গাপুরে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ফসলি কৃষি জমিগুলো পরিণত করা হচ্ছে গভীর পুকুরে। অপরিকল্পিতভাবে গত একমাসে উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে হাজার হাজার বিঘা ফসলি জমিতে পুকুর খনন করা হয়েছে।
এক্সক্যাভেটর দিয়ে মাটি কেটে ইটভাটাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে একদিকে জমির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে, অন্যদিকে বিনাশ হচ্ছে ফসলি জমি। কমছে ফসলি জমির পরিমাণও। এছাড়া উঁচু জমি গর্তে পরিণত হওয়ায় সেচ কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। কৃষকরা পুকুর খনন বন্ধের দাবিতে মানববন্ধনসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছে একাধিক বার। কিন্তু এরপরও কোনো সুরাহা মিলছে না।
অভিযোগ উঠেছে, পুকুর খননে দুর্গাপুরে অন্তত শতাধিক দালালচক্র কাজ করছে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ম্যানেজ করে দালালদের মাধ্যমে অবৈধভাবে এসব পুকুর খনন করা হচ্ছে। এতে সাধারণ কৃষকরা তাদের কাছে পুরোপুরিভাবে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। এমনকী পুকুর খনন করতে জমি ইজারা না দিতে চাইলে জমির মালিকদের ভয়-ভীতি দেখানো হচ্ছে এখন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, গত সাত বছরে উপজেলায় প্রায় চার হাজার হেক্টর ফসলি জমিতে পুকুর খনন করা হয়েছে। এভাবে পুকুর খনন চলতে থাকলে উপজেলার আবাদি জমি আশঙ্কাজনক হারে কমবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে প্রায় ৪শ স্থানে ৬শ বিঘা ফসলি জমিতে পাল্লা দিয়ে পুকুর ও দিঘি খনন চলছে। ওয়াজের মোড়ে ১৫ বিঘা জমিতে, বাগমা বিলে ৩০ বিঘা, ঝলমরিয়া বিলে ১০ বিঘা, মাড়িয়া বিলে ৮ বিঘা, পানানগর বিলে ২৫ বিঘা, আংরার বিলে ৯০ বিঘা, নওপাড়া ও পালশার বিলে ৫০ বিঘা ফসলি জমিতে পুকুর খনন চলছে।
নারায়ণপুরে ২০ বিঘা, পাচুবাড়ী বিলে ১০০ বিঘা, আলীপুর বালিকা বিদ্যালয় সংলগ্ন বিলে ৪০ বিঘা, সারপুকরিয়া বিলে ৫০ বিঘা, চুলকানি বিলে ৪৫ বিঘা, আনুলিয়া বিলে ৪০ বিঘা। এছাড়াও ধরমপুর, তেবিলা, কয়মজমপুর, আলীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে চলছে পুকুর খনন।
স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, একের পর এক খনন করা পুকুরে গিলে খাচ্ছে ফসলি জমি।
আর অধিকাংশ মাটি ট্রাকের মাধ্যমে স্থানীয় ইটভাটাসহ বিভিন্ন স্থানে সরবারহ করা হচ্ছে। ট্রাকের মাটি আর ধুলার আস্তরণে বেহাল গ্রামীণ ও আঞ্চলিক সড়কগুলো। এতে দুর্ভোগে পড়ছে সব ধরনের যানবহন ও পথচারী। অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খননের কারণে বর্ষা মৌসুমে বন্যার পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে বাড়ে জনদুর্ভোগ।
কৃষকদের অভিযোগ, নানাভাবে স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চলছে এসব পুকুর খনন কাজ। দুর্গাপুর থানা পুলিশ প্রতিটি পুকুর খননে বিঘাপতি মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে পুকুর খননের সুযোগ করে দিচ্ছে।
এক শ্রেণির দালালচক্র কৃষকদের অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে ৮-১০ বছরের জন্য পুকুর খননের কাজে জমি ইজারা নিচ্ছেন। আবার ইজারা দিতে না চাইলে জমির মালিকদের ভয়-ভীতি দেখানো হচ্ছে। রাজি না হলে জোর করে রাতারাতি পুকুর খনন করা হচ্ছে। ফলে কৃষকরা নিরুপায় হয়ে পড়েছেন। বারবার অভিযোগ জানালেও প্রশাসন নির্বিকার।
উপজেলার আলীপুর গ্রামের কৃষক শাহজাহান মন্ডল বলেন, আমার জমি দিতে না চাইলেও স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যক্তি জোর করে পুকুর খনন করছে। ওই জমি ছাড়া আমার আর কোনো জমি নেই। আমি নিরুপায় হয়ে পড়েছি।
কৃষক আমজাদ আলী জানান, যে হারে পুকুর খনন হচ্ছে তাতে ফসলি মাঠ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমার পান বরজের পাশে অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খনন চলছে।
জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মসিউর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, কৃষি জমি সুরক্ষায় আইন আছে। তবে শ্রেণি পরিবর্তন করে পুকুর খনন করা যাবে না। পুকুর খনন বন্ধ করা অত্যন্ত জরুরি। না হলে অচিরেই এই উপজেলার খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে।
তবে বিষয়টি মানতে নারাজ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শুভ দেবনাথ। তিনি বলেন, পুকুর খনন বন্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। গত সপ্তাহেও অভিযানে বেশ কিছু ভেকু মেশিন অকেজো করা হয়েছে।
আর রাজশাহীর দুর্গাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসমত আলী বলেন, বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব উপজেলা সহকারী ভূমি কমিশনারের। এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ না পেলে আমাদের কিছু করার নেই।
রাজশাহী জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল বলেন, ফসলি জমিতে পুকুর খননের ওপর সরকারের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। কেউ ফসলি জমিতে পুকুর খনন করলে তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদি কেউ এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেয়, আর তার অভিযোগ যদি আমার কাছে আসে তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০২১
এসএস/এএ