ঢাকা: রাজধানীর লালবাগের পোস্তায় চলছে কোরবানির পশুর চামড়া কেনাবেচার ধুম। কিন্তু আড়তদারদের সিন্ডিকেটের কারণে এবারও পানির দামে বিক্রি হচ্ছে কোরবানির পশুর চামড়া।
ফলে পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছেন বহু মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী। তারা বলেন, পানির দাম আছে কিন্তু চামড়ার দাম নেই! নানা অজুহাত দেখিয়ে চামড়ার দাম কমিয়ে দিয়েছেন পাইকারি আড়তদাররা। ফলে বাধ্য হয়ে লোকসান দিয়ে পানির দামে চামড়া বিক্রি করছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা। আকার ভেদে পোস্তায় প্রতি পিস গরুর চামড়া বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৫৫০ টাকায়।
তবে আড়তদাররা বলেছেন, তারা সরকার নির্ধারিত দাম দিয়ে চামড়া সংগ্রহ করছেন। ক্ষেত্র বিশেষে দাম একটু কম বেশি হতে পারে।
বুধবার (২১ জুলাই) দুপুর লালবাগের পোস্তায় গিয়ে দেখা যায়, বিকেল ৩টার পর থেকেই ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে কোরবানির চামড়া আসতে শুরু করে।
আড়তদারদের হাঁকডাকে সরব হয়ে উঠেছে লালবাগের শায়েস্তা খান, রাজ নারায়ণ ধর রোডসহ আশপাশের বিভিন্ন রোড। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন এলাকার মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চামড়া সংগ্রহ শুরু করেছেন। এ বছর পোস্তার আড়তগুলোতে বড় চামড়া ৫৫০ টাকা, মাঝারি ৪০০ টাকা ও ছোট চামড়া ২৫০ টাকা দরে সংগ্রহ করছেন অড়তদাররা।
তবে করোনাকালে কোরবানির ঈদ হওয়ায় পশুর চামড়া কম সংগ্রহ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি পশু কোরবানি এখনো পুরোপুরি শেষ না হওয়ায় পোস্তায় এখনো পুরোদমে শুরু হয়নি কাঁচা চামড়ার বেচাকেনা। রাতের দিকে পুরোদমে চামড়া কেনাবেচা শুরু হবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
পোস্তার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলা জানা যায়, চামড়া সংগ্রহের প্রস্তুতি নেওয়া হলেও বিকেল ৫টার পর থেকে চামড়া কেনাবেচা জমে ওঠে। গভীর রাত পর্যন্ত চামড়া সংগ্রহ করা হবে। সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সে দামে শুধু লবণযুক্ত চামড়া সংগ্রহ করা যাবে। কিন্তু বর্তমানে যে চামড়া আসছে সেটা লবণ ছাড়া, তাই এ চামড়ার দামও কম। কারণ প্রতিটা চামড়ার জন্য আরও ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা খরচ করতে হবে প্রসেসিংয়ে জন্য। এজন্য ব্যবসায়ীরা চামড়ার গুণগত মান দেখে চামড়ার দাম নির্ধারণ করছেন। এতে প্রতিটি চামড়ার দাম গড়ে ২৫০ থেকে ৫৫০ টাকা পড়ছে। গতবছরও এই দামে বিক্রি হয়েছে। চামড়া প্রসেসিংয়ের পরে সাভারের ট্যানারিগুলোতে পাঠিয়ে দেবেন আড়তদাররা। এছাড়া দেশের সবচেয়ে বড় কাঁচা চামড়ার আড়তে গতবারের মতো এবারো লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চামড়া সংগ্রহ হবে না বলে আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের।
রূপগঞ্জ থেকে ট্রাকে করে ৩০০ চামড়া এনেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ী মো. ওমর ফারুক ফারুক। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, গত ১০ বছর দরে চামড়ার ব্যবসা করছি। কিন্তু গত দুই তিন বছর ধরে পানির দরে চামড়া বিক্রি করছি। পানির দাম আছে ভাই, চামড়ার দাম নেই। গত এক বছরে সবকিছুর দাম বাড়ছে কিন্তু চামড়ার দাম বাড়েনি। যে চামড়া ২ হাজার টাকায় বিক্রির কথা, সেই বড় চামড়া বিক্রি করছি ৫৫০ টাকায়। মাঝারি চামড়া ৩০০ টাকায়, ছোট চামড়ার তো কোনো দামই নেই। আর ছাগলের চামড়া ১০ টাকা। সব চামড়া লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে হয়েছে।
সরকার তো দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে তাহলে লোকসান হবে কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আড়তদাররা সিন্ডিকেট করে চামড়া কিনছে। সরকার যদি তদারকি করতো তাহলে এমনটা হতো না।
মৌসুমি ব্যবসায়ী লোকমান মিয়া বলেন, চামড়াজাত পণ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। কিন্তু চামড়ার দাম বাড়েনি। করোনার সময় সবকিছুর দাম বেড়েছে শুধু চামড়ার দাম বাড়েনি। ৫০০ পিস চামড়া এনেছিলাম। ছোট, বড় গড়ে ৫৫০ টাকা দরে বিক্রি করে দিয়েছি। কিছু করার নেই। এক ঘণ্টা পড়ে বলবে চামড়ার মান খারাপ হয়ে গেছে। তখন আরও কম দাম দেবে। তাই বাধ্য হয়েই বিক্রি করতে হয়েছে। আমরা কার কাছে যাবো, কার কাছে বলবো, আল্লাহ ছাড়া বলার কেউ নেই!
এ বিষয়ে ছমির হানিফ অ্যান্ড সন্সের মালিক হাজী মো. ছমির উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, ৪৬ বছর ধরে চামড়ার ব্যবসা করছি। এমন বাজার আর দেখি নাই। আজকে গড়ে প্রতিটি চামড়া আমরা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা দর দিচ্ছি। আগামী তিনদিন আমরা এই কাঁচা চামড়া নেবো। পড়ে লবণযুক্ত চামড়া নেবো।
এস এম কামাল অ্যান্ড সন্সের আনোয়ার বাংলানিউজকে বলেন, সরকার লবণযুক্ত চামড়ার দাম গতবছর থেকে ৫ টাকা বেশি নির্ধারণ করেছে। আমরা সেই চামড়া সরকার নির্ধারিত দামেই কিনবো। কিন্তু আগামী দুই দিন পর্যন্ত লবণ ছাড়া কাঁচা চামড়া আসবে সেটা আমরা নির্ধারিত দাম থেকে ৩/৪ টাকা কমে কিনছি। যা গত বছরের বিক্রি হওয়া চামড়ার দামের সমান পড়ে যাচ্ছে। কারণ একটি চামড়া কেনার পর প্রসেস করতে আমাদের ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পড়ে যায়। এজন্য লবণ ছাড়া চামড়ার দাম কম।
রিয়াজ উদ্দিন ট্রেডাসের মালিক মো. রিয়াজ বলেন, গরুর চামড়ার দাম না থাকায় এ বছর ছাগলের চামড়া কিনছি। আগে যেখানে একটি বড় গরুর চামড়ার দাম ছিলো ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা, সেখানে এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ টাকা। তারপর প্রসেসিং খরচ সব মিলিয়ে গরুর চামড়া কিনলে লোকসানে পড়তে হবে। তাই ছাগলের চামড়া কিনছি প্রতি পিস ১২ টাকা দরে।
তিনি বলেন, করোনার জন্য আমাদের চামড়া রপ্তানি কমে গেছে। ফলে ট্যানারি মালিকরাও চামড়া কম নেবে। কারণ তাদের প্রচুর মজুদ রয়ে গেছে। রপ্তানি বাজার ভালো হলে যদি চামড়ার দাম বাড়ে।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সভাপতি আফতাব খান বাংলানিউজকে বলেন, ঢাকা শহর ও এর আশেপাশের কোরবানির পশুর চামড়া পোস্তায় আসতে শুরু করেছে। দুপুর থেকেই আমরা কাঁচা চামড়া কেনা শুরু করেছি। বিকেলের দিকে কেনাবেচা জমে উঠেছে। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া যত তাড়াতাড়ি আমাদের কাছে আনবেন তত ভালো। আমরা আগেও বলেছি, চামড়া কেনার সময় যেন ভেবেচিন্তে কেনে। চামড়ার মান বুঝে আমরা দাম দেব। আমাদের কাছে যারা আসছেন সবাই ন্যায্য দাম পাচ্ছেন। এখানে (পোস্তা) দাম কম দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
চলতি বছর ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। গত বছর যা ছিল ৩৫ থেকে ৪০টাকা। ঢাকার বাইরে ৩৩ থেকে ৩৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে গত বছর যা ছিলো ২৮ থেকে ৩২ টাকা। এ ছাড়া সারা দেশে খাসির চামড়া ১৫ থেকে ১৭ টাকা। গত বছর যা ছিলো ১৩ থেকে ১৫ টাকা। এক্ষেত্রে গত বছরের চেয়ে দাম বাড়ানো হয়েছে। পাশাপশি বকরির চামড়ার দাম নির্ধরণ করা হয়েছে ১২ থেকে ১৪ টাকা, গত বছর যা ছিল ১০ থেকে ১২ টাকা।
ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুযায়ী, বছরে বাংলাদেশে প্রায় ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২৯ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০২১
জিসিজি/এমজেএফ