ঢাকা: ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ না হওয়া, কর আহরণের দুর্বলতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের অভাব এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বৈষম্য এই চার উপাদান অর্থনীতির প্রধান বিচ্যুতি বলে জানিয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্জনও আছে, বিচ্যুতিও আছে।
মঙ্গলবার (৩০ আগস্ট) দুপুরে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) অডিটোরিয়ামে ইআরএফ ডায়লগে তিনি এ কথা বলেন।
ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় ডায়লগে সভাপতিত্ব করেন সভাপতি শারমিন রিনভী।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি জটিল এবং সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশে এবং বিশ্বে এ রকম পরিস্থিতি হতে পারে তা আগেই বলা হয়েছিল। পাশাপাশি এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় স্বল্পমেয়াদি স্থিতিকরণ কর্মসূচি জরুরি উল্লেখ করা হয়েছিল। যে কারণে জিডিপির অভিলাষ সংযত করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আর্থিক ও বৈদেশিক লেনদেন নীতি গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে। বৈদেশিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, বিনিময় হার এবং মূল্যস্ফীতির যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা দ্রুত শেষ হবে না। বাংলাদেশের মূল সমস্যা বৈদেশিক লেনদেনে নয়। মূল সমস্যা আর্থিক খাতের দুর্বলতা, প্রয়োজনীয় রাজস্ব সংগ্রহ না হওয়া। যে কারণে জ্বালানিতে ভর্তুকি, দরিদ্রদের খাদ্য সহায়তা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
দেবপ্রিয় বলেন, প্রবৃদ্ধি মূলত রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ দ্বারা ধাবিত। বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়েনি। জিডিপির ২৩ বা ২৪ শতাংশে আটকে আছে। রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ৫ থেকে ৬ শতাংশ থেকে ৭ থেকে ৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগও হয়নি। এফডিআই জিডিপির এক শতাংশের নিচে। যা গতিশীল অর্থনীতির জন্য যথেষ্ট নয়। রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বেশি হলে সেগুলোর সুবিধা নিয়ে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়ে। কিন্তু বাংলাদেশে সেটা ঘটেনি। বাংলাদেশের অবস্থা এক ইঞ্জিনে চলা উড়োজাহাজের মতো। যে বেশি দূর যেতে পারে না। কিছু দূর চলার পর রানওয়ে খুঁজতে থাকে।
তিনি বলেন, এক দশক ধরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ৫ থেকে ৭ শতাংশ হারে। এর অর্থ আয় বাড়ছে। তাহলে কর সংগ্রহ হচ্ছে না কেন? তাহলে কি সংগ্রহ করা হচ্ছে না, নাকি হিসাবের গরমিল আছে। কর সংগ্রহ করতে না পারার কারণে এখন আমদানি করা যাচ্ছে না। খাদ্য সহায়তা বাড়ানো যাচ্ছে না। শুল্ক কমাতে পারছে না। পরোক্ষ কর থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করতে হচ্ছে বেশি। যা সাধারণ মানুষকে চাপে ফেলছে।
তিনি বলেন, দেশে প্রতিযোগিতাপূর্ণ ব্যবসায়িক পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না। বিশেষ জায়গা থেকে বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এতে মেধাভিত্তিক ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ব্যক্তি বিনিয়োগ বিকশিত হচ্ছে না। ফলে ক্ষতি হচ্ছে সরকার, মানুষ ও দেশের। বিদ্যুৎ-জ্বালানিতে প্রতিযোগিতার সুযোগ তুলে নেওয়া হয়েছে। বিচারের সুযোগও তুলে নেওয়া হয়েছে।
রাজস্ব ব্যবস্থায় দুর্বলতার কথা বললেন, তবে সংস্কার কোথায় প্রয়োজন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আর্থিক খাতের দুর্বলতা হলো মৌলিক দুর্বলতা। আর বৈশ্বিকখাতে দুর্বলতা মোকাবিলা করার জন্য আর্তিকখাতের এ অবস্থা দুর্বলতা সৃষ্টি করেছে। চাইলে দৃশ্যমান অনেক সম্পত্তিতে আয়কর ধরার সুযোগ রয়েছে।
খেলাপী ঋণ বিষয়ক এক প্রশ্নে তিনি বলেন, খেলাপী ঋণ পুঁজিবাজার আইনি ব্যবস্থার কথা যদি বলেন, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাপনা এগুলো এমন একটা প্রতিষ্ঠান কাজ না করলে আধুনিক সমাজ আসে না। খেলাপী ঋণ শুরু হয়েছে ১৯৮০ সালে। সব সময় রাজনৈতিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত ব্যক্তিরাই খেলাপী ঋণের সবচেয়ে বড় সুবিধা ভোগী। আমি বারবার বলি সরকার নিজেই নিজের ভিকটিম। সংস্কার না করার ফলে ২০১৪ সাল পর্যন্ত যে উৎসাহ দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র, সরকারি ব্যবস্থা বা প্রশাসনকে সংস্কারের চেষ্টা করা হয়েছিল। ২০১৪ সালের পর থেকে আর দেখা যায়নি। কারণ সংস্কার হলে যারা সুবিধা পাবে তারা অনেক ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন, আর যারা অসুবিধায় পড়বে তারা অনেক বড় এবং সংগঠিত।
দেশ চাপে আছে দাবি করে এই বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বলেন, বাংলাদেশ চাপে আছে কিন্তু সংকটে নাই। কিন্ত চাপ যদি সময়মতো মোকাবিলা না করা হয় বা অস্বীকারের মনোভব থাকে তাহলে চাপ কিন্তু কাঠামোগত সমস্যায় রূপ নেবে। এটাই অর্থনীতির নিয়ম। চাপ সময়মতো নিরসন করতে হবে। চাপ সময়মতো ঠিক না করলে সংকট বাড়বে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩২ ঘণ্টা, আগস্ট ৩০,২০২২
জিসিজি/এমএমজেড