ঢাকা: সরকার রাজনৈতিক ঘাটতি ঢাকতে দৃশ্যমান প্রকল্প হাতে নেয় বলে জানিয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে সরকারের পক্ষ থেকে ভৌত অবকাঠামোতে যে পরিমাণ ব্যয় করা হয়েছে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সে পরিমাণ মনোযোগ দেওয়া হয়নি।
মঙ্গলবার (৩০ আগস্ট) দুপুরে ইআরএফ অডিটোরিয়ামে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম আয়োজিত ইআরএফ ডায়লগ এসব কথা বলেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
ইআরএফের সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলামে সঞ্চালনায় ডায়লগের উপস্থিত ছিলনে ইআরএফ সভাপতি শারমিন রিনভী।
মেগা প্রকল্প প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দুই-তিনটা সবচেয়ে বড় প্রকল্প আদৌ বাংলাদেশের জন্য উপকারী হবে কিনা জানি না। আমি কোন প্রকল্পের কথা বলছি, আপনারা বুঝতে পেরেছেন। যে প্রকল্পটি (রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প) ১২ বিলিয়ন ডলারে বাস্তবায়ন করছি, একই প্রকল্প ভারত ৩ বিলিয়ন ডলারে বানাচ্ছে। তাহলে কত এদিক-ওদিক হয়েছে আপনারা দেখতে পাবেন।
সরকার ভৌত অবকাঠামোতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করছে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সেই বরাদ্দ থাকছে না উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ২০টি মেগা প্রকল্পের জন্য জিডিপির ২ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। অথচ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ থাকছে জিডিপির এক শতাংশ। শিক্ষাতেও সমপরিমাণ। রাজনৈতিক শক্তির বৈধতার জন্য খুব দ্রুততার সাথে দৃশ্যমান ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন করতে চাচ্ছে। রাজনৈতিক ঘাটতি পূরণের চেষ্টা হচ্ছে। কারণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বিনিয়োগের ফলাফল আসতে দশকের বেশি সময় লাগে। রাজনৈতিক চক্রে এই সময় নেই। পাশাপাশি সরকারের রাজনৈতিক দর্শনের কারণে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বৈষম্য হচ্ছে। করোনার সময় সহায়তা বিতরণে বড় ধরনের বৈষম্য দেখা দিয়েছে, যার যা প্রাপ্য তা নথিভুক্ত হয়নি।
গত এক দশকের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে সিপিডির সম্মানীয় এ ফেলো বলেন, উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে চার ধরনের বিচ্যুতি হয়েছে, দেশের অর্থ লুণ্ঠন হয়েছে।
লুণ্ঠন দেশে এইবারই প্রথম নয়— উল্লেখ করে তিনি বলেন, ৮০ দশকে লুণ্ঠন শুরু হয়েছে। প্রথম লুণ্ঠন হয়েছিল মিশ্র ঋণের মাধ্যমে, যা হয়েছিল ডিএফআইয়ের মাধ্যমে। এরপর বাংলাদেশের পুঁজিবাজার হলো লুণ্ঠন করার দ্বিতীয় উৎস। অনেক ক্ষেত্রে অস্তিত্ববিহীন কোম্পানিকেও পুঁজিবাজারের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ তরল টাকা দেওয়া হয়েছিল। এরপর ১৯৯৬ সালে আইপিওর মাধ্যমে জ্ঞান মানহীন কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করা হয়। যার ফলে পুঁজিবাজারেও বিচ্যুতি ঘটে। এখনও অনেক কোম্পানি বাজারে আছে বা ছিল যারা বিনিয়োগকারীরদের অর্থ লুণ্ঠন করে চলে গেছে। এসব বিচ্যুতির কারণেও দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর পথে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পদ্মা সেতু নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, পদ্মা সেতু হবে না, এ কথা কেউ বলে নাই। বলা হয়েছিল যে অর্থায়ন করা হয়েছিল, সেটা যৌক্তিক কিনা। যেটা বলা হয় পদ্মা সেতু নিজের টাকায় করা হয়েছে। আসলে টাকা ঋণ করে করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ করা হয়েছে। যেটা অন্য কোনো খাতে ব্যয় হতো। সেজন্য শিক্ষা স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বাড়াতে পারিনি। এই ছাড়টা কি ঠিক হয়েছে কিনা হয় নাই সেটা অর্থনীতি আগামীতে বলবে। আমি মনে করি এই ছাড়টা সরকার বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়ে করেছে। আশা করছি বিনিয়োগের মাধ্যমে এটা মিটিয়ে দেওয়া যাবে। আপনারা যারা বলেন, একটা বড় অংশ পদ্মা সেতু নিয়ে বিরোধিতা করেছিল। মূলত বিরোধিতা করেছিল অর্থায়নের বিষয়ে। পদ্মা সেতু করার জন্য সরকার অভিনন্দনের দাবিদার। তবে অর্থায়নের দিক থেকে আরও সাশ্রয়ী হওয়া যেতো। যে টাকা বিকল্প ব্যবহারের জায়গা ছিল।
জ্বালানি তেলের দাম ৫ টাকা কমানো নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটি আদৌ কোনো মিটিং করে? আপনারা কেউ বলতে পারেন, অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির শেষ সভা কবে হয়েছে? শেষ কবে, কী আলোচনা হয়েছে বলতে পারবেন? কেউ বলতে পারেন? কেবিনেটেও তো এই আলোচনা আমরা শুনি নাই। তাহলে জ্বালানি তেলের সমন্বয় কোথা থেকে হলো? এতে করে কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না।
জনশক্তি রপ্তানি বেড়েছে তবে রেমিট্যান্স বাড়েনি। কার্ব মার্কেটে প্রচুর ডলারের ডিমান্ড দেখতে পাচ্ছি, ফলে অনেকেই মনে করেন এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য অর্থপাচার সম্পৃক্ত— জানতে চাইলে বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এটা পুরানো জিনিস। এই মুহূর্তে ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রার যে চাহিদা শুধু উচ্চ আমদানি ব্যয় দিয়ে ব্যাখা করা যাবে না। উচ্চ আমদানি ব্যয় নিঃসন্দেহে একটা বড় চাপ সৃষ্টি করছে। অনিশ্চয়তার সাথে অর্থ পাচারের খুব দৃঢ় সম্পর্ক আছে। নির্বাচনের আগে গরিবরা বিদেশ থেকে টাকা পাঠায় নিজ এলাকায় অর্থায়নের জন্য, অন্যদিকে অর্থবান মানুষরা দেশের বাইরে টাকা নিয়ে যায় এই নির্বাচনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে। সরকারের কাঠামো দক্ষতা যদি না থাকে তাহলে এটা আটকানো খুব কঠিন। বাংলাদেশে আইন আছে, রাজনৈতিক অঙ্গীকার আছে, তারপরও কেন পাচার বন্ধ হয় না। কারণ আমরা ঠিক মতো কর পাই না। অথচ টাকা যারা পাচার করছে, তাদের আমরা কর সুবিদা দিয়ে থাকি, যা রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে অর্থনৈতিক বাস্তবতার চরম বৈপরীত্য সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪২ ঘণ্টা, আগস্ট ৩০, ২০২২
জিসিজি/এমজেএফ