খুলনা: চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় নিম্নআয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে সরকার ওএমএস (ওপেন মার্কেট সেল) কর্মসূচি চালু করেছে।
খুলনায় অভিযোগ রয়েছে, স্বল্প আয়ের মানুষের সরকারি এ চাল ও আটা খোলাবাজারে (ওএমএস) বিক্রি না করে তা কালোবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন কিছু সরবরাহকারী (ডিলার)।
চালের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার গরিব ও দুস্থ মানুষের জন্য ওএমএসের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে চাল বিক্রির ব্যবস্থা করে। সেই চাল বিক্রি না করে অসাধু ব্যবসায়ীরা কালোবাজারে চাল বিক্রি করে আসছে। এমন সংবাদের ভিত্তিতে মঙ্গলবার (১ নভেম্বর) র্যাব খুলনা মহানগরীর বার্মাশীল রোডে কয়েকটি গোডাউন গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখে। তারই ধারাবাহিকতায় র্যাব সেখানে অভিযান চালিয়ে প্রায় ১৪ হাজার কেজি চাল উদ্ধার করে। এ সময় গোডাউন মালিক নাদিম আহমেদ ও তার কর্মচারী রবিউল ইসলামকে আটক করা হয়।
র্যাব জানায়, কিছু সংখ্যক ডিলার দরিদ্রদের কাছে ৩০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি না করে সেই চাল কালোবাজারে বেশি দামে বিক্রি করে দেন। নাদিম আহমেদ অসাধু ডিলারদের কাছ থেকে চাল কিনে তা বিভিন্ন বাজার ও দোকানে বিক্রি করতেন।
তবে আটক হওয়া ওই দুই ব্যক্তি ৮ জন ডিলারের নাম বলেছে। এছাড়া খাদ্য বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী এ কাজে সহযোগিতা করে বলেও উল্লেখ করেছে বলে জানা গেছে।
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে ন্যায্যমূল্যে চাল ও আটা বিক্রি না করে অধিক দামে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে গোপনে বিক্রি করছেন বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ডিলার। খুলনার বড় বাজারের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী এসব চাল কিনছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
যাদের মধ্যে রয়েছে কাজী অ্যান্ড সন্স, পলি এন্টারপ্রাইজ,কাশফিয়া এন্টারপ্রাইজ,রাবেয়া এন্টারপ্রাইজ, আশরাফ ভাণ্ডার, উজ্জ্বল ব্রিডার্স, বিসমিল্লাহ স্ট্রোর ও উজ্জ্বল ট্রেডার্স।
এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা ডিলারদের কাছ থেকে কম দামে চাল কিনে বস্তা পরিবর্তন করে বেশি দামে অন্য দোকানে বিক্রি করে। এদের গোডাউন বার্মাশিল রোড, কালীবাড়ি এলাকায় এবং কোহিনুর গলিতে অবস্থিত।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মোটা চাল নুরজাহান মার্কা বস্তায় এবং চিকুন চাল প্লাস্টিকের জোড়া কবুতর মার্কা বস্তায় ভরে বিক্রি হচ্ছে। আটা মিল মালিকরা কিনে তাদের নিজস্ব বস্তায় ভরে বিক্রি করেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, খোলা বাজারে বিক্রির (ওএমএস) চাল ও আটা ব্যাপক লুটপাট করছেন ডিলার ও খাদ্য কর্মকর্তারা।
যারা মনিটরিং করার দায়িত্বে, তাদের যোগসাজশেই বস্তা বদল করে রাতারাতি সরকারি কম মূল্যে বিক্রির এই খাদ্যপণ্য চলে যাচ্ছে আড়তদারের ঘরে। মাঝখানে সংশ্লিষ্ট খাদ্য কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে ঢুকছে লাখ লাখ টাকার কমিশন। এভাবে গরিবের চাল লুটপাটের ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে খুলনায়।
প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানান, কোটি কোটি টাকার ভর্তুকি দিয়ে সরকার যে ওএমএস চালু রেখেছে তার সুফল গরিব মানুষ না পেলেও পেয়ে যাচ্ছে ওএমএসের ডিলারা।
ওএমএস চালের এই দুর্নীতি এখন ওপেন সিক্রেট। প্রশাসনের সবাই জানে অথচ কেউ ধরা পরে না। কারো লাইসেন্স বাতিল হয় না, কেউ শাস্তিও পায় না। এটা একটা আজব ব্যাপার।
অভিযোগ রয়েছে, খুলনার নতুন বাজারে চান মিয়া নামে এক ডিলার যিনি রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। অথচ এই ওএমএস ছাড়া তার আর কিছুই ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। সরকারি চাল এবং আটার লাইসেন্স থাকলে এত টাকার মালিক হওয়া যায় তা এসব ডিলার দেখলেই বোঝা যায়।
জানা যায়, অনেক ডিলারতো আটার বস্তা গোডাউন থেকেই পাইকারি বাজারে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করে দেন। অধিকাংশ ডিলার সরকার দলীয় লোক হওয়ায় সাধারণ মানুষ কোনো প্রতিবাদ করে না।
সচেতন মহল বলছেন, এভাবে ওএমএসের চাল চোরাই পথে বাজারে চলে আসার কারণে সরকার বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে চোরাকারবারিদের হাত ঘুরে আসা খোলাবাজারের চাল সাধারণ মানুষকে উচ্চমূল্যে কিনতে হচ্ছে। সঙ্গত কারণে ওএমএস কর্মসূচি কার্যত কাজে আসছে না।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিস সূত্রে জানা যায়, খুলনা মহাগরীতে ৯২ জন ডিলারের মাধ্যমে চাল বিক্রি করা হয়। প্রতিদিন ৩৭ জন ডিলার চাল তুলতে পারেন। এর মধ্যে ১৩টি ট্রাকে বিক্রি করা হয় এবং বাকিগুলো দোকানে বিক্রি করা হয়।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) খুলনার সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বাংলানিউজকে বলেন, অতি দরিদ্র মানুষের কষ্ট লাঘবে সরকার ওএমএসের মাধ্যমে চাল আটা বিক্রির কর্মসূচি নিয়েছে। উদ্দেশ্য অতি মহৎ হলেও অতি দরিদ্র লোকজন তা থেকে খুব বেশি উপকৃত হতে পারছে না। কিছু নিম্ন রুচির অতি লোভী মানুষের কারসাজিতে সেই চাল ঠিকমতো দরিদ্রদের হাতে পৌঁছে না। ডিলাররা চাল তুলে কালোবাজারে বিক্রি করে। যারা অতি দরিদ্রদের চাল ও আটা এভাবে আত্মসাৎ করে তারা অতি ঘৃণ্য অপরাধী। তাদের কঠোর শাস্তি না হলে আত্মসাৎ বন্ধ হবে না, সরকারের কোনো কর্মসূচিও লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না। ব্যক্তিগত স্বার্থে সরকারি সম্পদের অপব্যবহার করার দায়ে ডিলারশিপ বাতিল করা হোক। একই সঙ্গে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় খুলনার সহকারী খাদ্য নিয়ন্ত্রক জাহেদুল ইসলাম শনিবার (৫ নভেম্বর) বাংলানিউজকে বলেন,ওএমএসের চাল কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত এমন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেলে ডিলারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
১ নভেম্বর বড়বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে ওএমএসের ১৪ হাজার কেজি চাল উদ্ধার ও এ সময় ২ জনকে আটক করা হয়েছিল, তাদেরকে কোন ডিলার চাল দিয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা বলেন, সেটি ওএমএসের চাল কিনা জানি না।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর রেশনের চাল অনেকে প্রয়োজন মিটিয়ে বাজারে বিক্রি করে। সে চাল ও ওএমএসের চাল একই গুদামের। তবে সেদিন আটকদের ব্যাপারে র্যাবের কাছে জানার চেষ্টা করেছি এর সঙ্গে কোনো কোনো ডিলার জড়িত আছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০২২
এমআরএম/এএটি