ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

শিক্ষাক্রম নিয়ে আলোচনায় ঢাবি প্রশাসনের বাধা, অপরাজেয় বাংলায় সমাবেশ

ইউনিভার্সিটি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০২৩
শিক্ষাক্রম নিয়ে আলোচনায় ঢাবি প্রশাসনের বাধা, অপরাজেয় বাংলায় সমাবেশ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১: আমরা কেন উদ্বিগ্ন?’ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের আলোচনা সভায় বাধা দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) প্রশাসন।  

বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) দুপুর আড়াইটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার থিয়েটার বিল্ডিংয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে এ আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।

 

বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং আয়োজনের সঙ্গে জড়িত ড. কাজী মারুফুল ইসলাম জানান, সভা উপলক্ষে মিলনায়তনের সামনে আলোচক ও শ্রোতারা জড়ো হন। সভা শুরুর নির্ধারিত সময়ের ১০ মিনিট আগে কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবদুল বাছির ফোনকলে এখানে প্রোগ্রাম করতে নিষেধ করেন। অধ্যাপক আবদুল বাছির আয়োজকদের জানান, প্রোগ্রামটি ‘সরকারবিরোধী’ জানিয়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সংস্থা এটি বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছে।

সভাটি কেন করতে দেওয়া হলো না জানতে চাইলে অধ্যাপক আবদুল বাছির বলেন, ‘তাদের লিখিত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা অনুমতি দিয়েছিলাম। কিন্তু দুপুর দুইটায় খবর পেয়েছি, এই প্রোগ্রামটি রাষ্ট্র, সরকার ও আমাদের জাতিসত্তাকে আঘাত করতে পারে। সে কারণে আয়োজককে ফোন করে সভাটি অন্য স্থানে করার কথা বলেছি। ’

তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সংস্থার লোকজন থাকে। তাছাড়া এই মিলনায়তনটি দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের নীতিমালায়ও সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধিতার শঙ্কা থাকলে অনুমতি না দেওয়ার বিষয়টি রয়েছে। ’

এদিকে সভা করতে না দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার সামনে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।

এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন বলেন, আমরা নতুন শিক্ষাক্রমের ভালো-খারাপ ও ফাঁক-ফোকর নিয়ে আলোচনার জন্য একটি আলোচনা সভা করতে চেয়েছি। এ ধরনের নিরীহ একটি প্রোগ্রামে যারা বাধা দেয়, তারা রাষ্ট্রের মঙ্গল চায় না। বর্তমান যে শিক্ষাক্রম করা হয়েছে, রাষ্ট্রের কেউ তার দাবি করেছিল? তবু একটি নতুন শিক্ষাক্রম চাপিয়ে দেওয়া হলো; যা একটি খোলস মাত্র।  

তিনি বলেন, ‘শিক্ষাব্যবস্থার মূল সমস্যা কারিকুলাম নয়। বরং অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাব, শিক্ষকদের পর্যাপ্ত বেতন না দেওয়া, স্কুল ম্যানেজিং কমিটিতে রাজনীতির প্রবেশ শিক্ষাব্যবস্থাকে নষ্ট করেছে। কোনো সরকার শিক্ষার মান পরিবর্তনে ব্যবস্থা নেয়নি। কয়েকটি মিশনারি স্কুল বাংলাদেশ ছেড়ে গেলে এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা পাতালে চলে যাবে। ’

‘খোলস বদলালেই সব ঠিক হয়ে যাবে? পুরনো কারিকুলামে কোচিং বাণিজ্য হয়, শিক্ষার্থীদের মুখস্ত করতে হয় বলে দোষারোপ করা হলো। এটি ডাহা মিথ্যা। কোচিং বাণিজ্য হয় ভালো শিক্ষক নিয়োগ না দেওয়ার কারণে। শিক্ষকরা লেখাপড়া ছাড়া অন্য সব কাজে ব্যস্ত থাকেন। ফটোকপি দিয়ে পড়াশোনা চলে, পাঠ্যবই খুলে দেখার সময় পায় না। '

তিনি আরও বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রম চালু করার জন্য যে উপযুক্ত পরিবেশের প্রয়োজন, তা বাংলাদেশে তৈরি করা হয়নি। ফিনল্যান্ড একদিনে আজকের অবস্থানে আসেনি। ১২০০ সাল থেকে ধীরে ধীরে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে। পৃথিবীর কোথাও একটি কারিকুলামের শতভাগ একসঙ্গে পরিবর্তন করা হয় না। সর্বোচ্চ ২০ শতাংশে পরিবর্তন আনে, যাতে ভুল হলেও তার নেতিবাচক প্রভাব কম পড়ে। ’

‘বাংলাদেশে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয় নিয়ে আসা হয়েছে। পৃথিবীর আর কোথাও এই বিষয় এভাবে পড়ানো হয় না। অথচ নবম-দশম শ্রেণীতে বিজ্ঞানকে সংকুচিত করা হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমে পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, রসায়ন থেকে তথ্যপ্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ’

কামরুল হাসান মামুন বলেন, ‘ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা অনুযায়ী আমাদের শিক্ষাক্রম বদলের কথা বলা হচ্ছে। সেখানে শিক্ষার্থীদের অনার্সের আগ্রহের বিষয় শিক্ষাবিজ্ঞান। শুধু এ বিষয়ে অনার্স করলেই হয় না। তিনি শিক্ষকতা করতে চান কি না মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টি জিজ্ঞাসা করা হয়। এটা হতে হয় তার প্রথম পছন্দ; এর জন্য প্যাশন প্রয়োজন। এদিকে বাংলাদেশে সব স্থানে ব্যর্থ হয়ে শেষ প্রাইমারি শিক্ষকের চাকরি করেন। তাদের বেতনও অসম্মানজনক। ’

‘নতুন শিক্ষাক্রমের বইয়ে চরম অবহেলা করা হয়েছে। প্রচ্ছদ তৈরি, কাগজের মান, বইয়ের কন্টেন্ট সবকিছুতেই অবহেলা করা হয়েছে। ’

বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিমুদ্দীন খান বলেন, ‘যে শিক্ষাক্রম চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার ভালো-খারাপ দিক নিয়ে আলোচনা করা দরকার। শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে ভবিষ্যত রূপরেখা নিয়ে কথা বলা আমার নাগরিক ও নৈতিক অধিকারে পরিণত হয়েছে। ’

তিনি বলেন, ‘যেকোনো ধরনের বিতর্ককে ভয় পাওয়া সরকারের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রকাশ। আমাদের প্রোগ্রামটি খুবই কোমল একটি আয়োজন ছিল। বাংলাদেশের সংবিধান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডার-১৯৭৩ আমাদের মতপ্রকাশের ও মুক্তচিন্তার স্বাধীনতা দিয়েছে। কিন্তু আমাদের মতপ্রকাশে বাধা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় আজ একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ে প্রবেশ করল। ’

সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক রাখাল রাহা বলেন, ‘যেসব অভিভাবক শিক্ষা নিয়ে কথা বলছেন তাদের মামলা দেওয়া হয়েছে; রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। সরকারের ভাব এমন, শিক্ষাক্রম এতই ভালো যে, এ বিষয়ে কথা বলা যাবে না। অভিভাবকরা কোথাও দাঁড়াতে পারছেন না। তাদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষকদের চাকরি, বেতন ও ম্যানেজিং কমিটির ভয় দেখিয়ে চুপ করানো হয়েছে। ’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাসির উদ্দিন বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রমে বিজ্ঞানের ৩০ শতাংশ রেখে বাকি অংশ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বিজ্ঞান ও গণিতকে বাদ দিয়ে শিল্প ও সংস্কৃতি, জীবন ও জীবিকা বিষয় প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এগুলো কারিগরি শিক্ষার অংশ হতে পারে, মূলধারার নয়। এভাবে চললে আগামীতে বিদেশ থেকে প্রশাসক আমদানি করতে হবে। ’

তিনি বলেন, ‘আপনারা ইংলিশ মিডিয়ামকে অক্ষুণ্ণ রাখলেন। শিক্ষাক্রমে ইংলিশ মিডিয়ামের মতো বিষয় নির্বাচনে স্বাধীনতা দেওয়া যেত। তা না করে বিজ্ঞান ও গণিতকে সংকুচিত করায় বাংলাদেশের শিক্ষা আন্তর্জাতিক মান থেকে পিছিয়ে পড়বে। ’

অনুষ্ঠানে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীন বক্তব্য রাখেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক এবং  অভিভাবক উপস্থিত ছিলেন।  

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০২৩
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।