ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক অনিয়ম (তৃতীয় পর্বের প্রথম কিস্তি)

রহমান মাসুদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০১২
নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক অনিয়ম (তৃতীয় পর্বের প্রথম কিস্তি)

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নানা অনিয়ম আর দুর্নীতিতে নিমজ্জিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রতিষ্ঠিত কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়। এ প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় অনিয়ম-দুর্নীতি তুলে আনতে সরেজমিন অনুসন্ধান চালায় বাংলানিউজ।



বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট রহমান মাসুদের অনুসন্ধানে কবি নজরুল ‍বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম নিয়ে আজ প্রকাশ করা হলো ধারাবাহিক প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্ব। আর এ পর্বে প্রকাশ করা হলো প্রশাসনিক অনিয়মের প্রথম কিস্তি। এতে উঠে এসেছে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির চিত্র।  

ময়মনসিংহ থেকে ফিরে: জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. সৈয়দ গিয়াস উদ্দিন আহমেদের বয়স ৬৫ পেরিয়েছে একযুগ আগেই। ৮০ ছুঁই ছুঁই এই ভিসি একটানা এক/দুই মাস করে বিনা ছুটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকেন। ফলে প্রায়শই বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। এই প্রতিবেদন তৈরির সময়ও ভিসি একটানা দুইমাসের অধিক বিনা ছুটিতে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। রুটিন দায়িত্বে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার প্রফেসর আবুল বাসার। ৭ আগস্ট বাংলানিউজের প্রতিবেদনের পর ভিসি গিয়াস উদ্দিন ঢাকা থেকে ত্রিশালে গেলেও এখন পর্যন্ত অফিস করেননি। অবস্থান করছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমেটরিতেই।

প্রফেসর আবুল বাসারও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃতি) অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। এই দুইমাস এ দুইজন একই সঙ্গে ভিসির দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি নথি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, একাধিক নথিতে ৮/০৭/২০১২ তারিখে ভিসি হিসেবে দুইজন স্বাক্ষর করেছন, যা গুরুতর প্রশাসনিক অনিয়ম।

এ বিষয়ে প্রফেসর আবুল বাসারকে প্রশ্ন করা হলে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, “আমি প্রশাসনিক বিষয়গুলোতে ভিসি হিসেবে স্বাক্ষর করে থাকি আর আর্থিক বিষয়ে ভিসি মহোদয় অনুমোদন দিয়ে স্বাক্ষর করেন। ”

এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযোগ উত্থাপন করে কোনো তদন্ত ছাড়াই নিয়ম বহির্ভূতভাবে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ বিষয়ে আমিনুল ইসলাম উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেন। উচ্চ আদালত সাময়িক বরখাস্তের আদেশ স্থগিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর রুল জারি করেন এবং আমিনুল ইসলামকে স্বপদে বহালের নির্দেশ দেন। কিন্তু ভিসি সৈয়দ গিয়াস উদ্দিন উচ্চ আদালতের এই নিদের্শ অমান্য করে ডেপুটি রেজিস্ট্রার হুমায়ুন কবীরকে রেজিস্ট্রারের (ভারপ্রাপ্ত) দায়িত্ব দেন। আমিনুল ইসলামের কক্ষ থেকে টেলিফোন লাইন পর্যন্ত কেটে নেওয়া হয়।

এ বিষয়ে আমিনুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, “আদালতের নির্দেশের পর আমি অফিস করতে শুরু করি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে কোনো কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে না। এ বিষয়ে আমি মাননীয় ভিসি মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করলে তিনি আমাকে বলেন, বিষয়টি আদালতে মীমাংসা হবে। ”

আদালত কাজে যোগ দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন একথা ভিসিকে বলার পর তিনি বলেন, “তাহলে আমরা এর বিরুদ্ধে আদালতে আপিল করব। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখন যা করছে, তা সুস্পষ্ট আদালত অবমাননা। ”

ভিসি সৈয়দ গিয়াস উদ্দিন অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. হাবিবুর রহমানকে প্রক্টর এবং নাট্যকলা বিভাগের প্রভাষক মুহাম্মদ রুহুল আমীন ও হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক রেজোয়ান আহমেদ শুভ্রকে সহকারী প্রক্টর হিসেবে নিয়োগ দেন। অথচ কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০০৬-এ পরিষ্কার উল্লেখ আছে, “সহকারী অধ্যাপক পদমর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষকদের মধ্যে থেকে এক বা একাধিক সহকারী প্রক্টর নিযুক্ত হতে পারিবেন। ”

অভিযোগ আছে ভিসি নিজের ক্ষমতা পোক্ত করতেই বিশ্ববিদ্যালয় আইন লঙ্ঘন করে প্রভাষকদের সহকারী প্রক্টর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। তারা অবৈধভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে দায়িত্বভাতাও উত্তোলন করছেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম শামসুর রহমানের সময়ে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত ১৩ জন শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ইউজিসি চার সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ২০০৯ সালের ৬ অক্টোবর গঠিত এ তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয় ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. মোঃ আব্দুল হাকিম ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উপ-সচিব ফেরদৌস জামানকে। তদন্তে কমিটি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনা বিভিন্ন অভিযোগের সত্যতা পায়।

সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম শামসুর রহমান তিনজন শিক্ষক-শিক্ষিকা ও ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ওই নিয়োগ নিয়ে ইউজিসি অস্বচ্ছতা, দলীয়করণ ও আত্মীয়করণের অভিযোগ এনে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্যকে সুপারিশ করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য ওই সুপারিশের প্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ পক্ষপাতমূলকভাবে মাত্র একজন শিক্ষককে শাস্তি দিয়েছেন। বাকিদের রেখেছেন বহাল তবিয়তে।
 
দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১০ সালের ১৪ জানুয়ারি ই‌উজিসির তদন্ত কমিটি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ গিয়াস উদ্দিনের কাছে সুপারিশ করে রিপোর্ট জমা দেয়।

এ রিপোর্টে ১৩ জন অভিযুক্ত ও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে- বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. খোন্দকার শাফায়েত হোসেন (বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থে কেনা মোবাইল ফোন ফেরত না দেওয়া এবং অতিরিক্ত মোবাইল বিল নেওয়া), বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুদ্দিন চৌধুরী (অনিয়মতান্ত্রিকভাবে নিয়োগ), একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মার্জিয়া আক্তার (প্রভাষক পদে পিএইচডি ডিগ্রিধারী বাদ দিয়ে নিয়োগ), সঙ্গীত বিভাগের চেয়ারম্যান ড. রশিদুন নবী (একদিনের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ), মো. হাফিজুর রহমান (নিয়োগের শর্তে উল্লিখিত অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক পদে নিয়োগ) সহকারী রেজিস্ট্রার হুমায়ুন কবির (অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ), শাখা কর্মকর্তা একেএম আশরাফুল আলম (দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ), হল সুপার নাসরিন আক্তার খানম (আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ), কম্পিউটার অপারেটর আমিনুল হক, জাহিদুল হোসেন, চালক এমদাদুল হক, ইলেকট্রিসিয়ান আশরাফুজ্জামান খান শোয়েব ও এমএলএসএস আকরাম হোসেন (আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ)।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রভাবশালী এক সিন্ডিকেট সদস্য নাম প্রকাশে আপত্তি জানিয়ে বলেন, “ওই রিপোর্টের ভিত্তিতে ১ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় শুধুমাত্র সঙ্গীত বিভাগের চেয়ারম্যান ড. রশীদুন নবীকে সাময়িকভাবে ওই পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে তার বিরুদ্ধে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ”

কিন্তু কোনো সিন্ডিকেট সদস্যই এ তদন্ত কমিটিতে থাকতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। পরে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য বর্তমান ট্রেজারার ড. আবুল বাসারকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটির অপর দুই সদস্য হচ্ছেন ত্রিশালের এমপি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য রেজা আলী ও বাকৃবির প্ল্যানিং ডিরেক্টর।

পরে ড. রশীদুন নবীকে ইউজিসির তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ আদেশের বিরুদ্ধে ড. রশীদুন নবী হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্ট সাময়িক বরখাস্ত আদেশ স্থগিত করেন। এর ফলে রশীদুন নবীর বিরুদ্ধে ৩ সদস্যের ওই তদন্ত কমিটিও তাদের কার্যক্রম স্থগিত রাখে।

অভিযুক্তদের মাঝে সাবেক কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. শাফায়েত হোসেন সরকার পরিবর্তনের পর চাকরি হারান। বাকিদের সবাই বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ব-স্ব পদে কর্মরত রয়েছেন। এর মধ্যে ড. শামসুদ্দিন চৌধুরীকেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ সিন্ডিকেটের সভায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে নয়, তাকে সরানো হয়েছে ২০১০ সালের আলোচিত সেই ২২ জুলাইয়ের ঘটনায় ‘নৈতিক দুর্বলতার’ অভিযোগের ভিত্তিতে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক অভিযোগ করে বলেন, “২০১০ সালের ২২ জুলাই গভীর রাতে নিজ বিভাগের শিক্ষিকা মার্জিয়া আক্তারের ডরমেটরির কক্ষে সময় কাটানো নিয়ে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যানের পদ থেকে ড. শামসুদ্দিন চৌধুরীকে সাময়িকভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়। অথচ ‘নৈতিক দুর্বলতার’ অভিযোগে অভিযুক্ত মার্জিয়া আক্তারকে ‘পরিস্থিতির শিকার’ বলে বাঁচিয়ে দেওয়া হয়। পাশাপাশি অভিযোগ থাকার পরেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ শিক্ষিকাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দোলনচাঁপা ছাত্রী হলের প্রভোস্ট নিয়োগ দেয়। ”

বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের ক্ষুব্ধ একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, “যেখানে অভিযুক্ত সবাই স্ব-পদে বহাল রয়েছেন সেখানে শুধুমাত্র রশিদুন নবীকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছে। ”

ই‌উজিসির গঠিত তদন্ত কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য ও সাবেক সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক এএনএম নজরুল ইসলাম বলেন, “ব্যবস্থা নেওয়া হলে ১৩ জনেরই হওয়া উচিত। সবাই তো একই দোষে দুষ্ট। ”

এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-রেজিস্ট্রার হুমায়ুন কবির বলেন, “এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। আরও কয়েকটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। ”

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ গিয়াস উদ্দিন আহম্মেদের সঙ্গে একাধিকবার তার ব্যবহৃত মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশ সময়: ১৬১৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০১২
সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।