জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে: দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে, অগনিত স্বজন হারানোর বিনিময়ে সকল পরাধীনতাকে জয় করে ১৯৭১ সালে লাল-সবুজের গর্বের পতাকা পেয়েছিল আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ। এরপরই শুরু হয় নব উদ্যমে মৃতপ্রায় স্বাধীন বাংলাকে গড়ে তোলার প্রয়াস।
হাঁটিহাঁটি পা-পা করে সকল বাধা পেরিয়ে এগিয়ে এসেছে আমাদের গর্বের সেই স্বাধীন বাংলা। এখন বিশ্বের কাছে এই দেশের পরিচিতি অনেক। এই গর্বের বাংলাদেশের পেছনে আমাদের দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি, ছোট-বড় প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন রকম অবদান রয়েছে স্বাধীনতার শুরু থেকেই।
নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিভিন্ন ভাবে অবদান রেখে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের গর্বিত অংশীদার হয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। ঠিক এমনি একটি প্রতিষ্ঠানের নাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা একই সুতোই গাঁথা। সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় এটি। এখানে রয়েছে অম্লান স্মৃতি বিজড়িত স্বাধীনতার প্রতীক সংসপ্তক ভাস্কর্য, দেশের দীর্ঘতম শহীদ মিনার এবং অমর একুশে।
এই ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যের জুড়ি মেলা ভার। হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। আর শীত এলে নানান পাখির কলতনে মুখোরিত না হয়ে পারা যায় না। হরেক রকম গাছ-গাছালির সারি, সবুজের সমারোহে আবৃত সারা ক্যাম্পাস। রাতে হঠাৎ শেয়ালের ডাক।
শীতের সকালে লেকের পাড় ধরে হাঁটতে গিয়ে চোখ শীতল হয়ে আসে লেকে ফোটা লাল শাপলার মাঝে লুকোচুরিতে মেতে ওঠা সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আসা অতিথি পাখির খেলা দেখে।
এই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি, ক্রিয়াজগত, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রগতি, সমৃদ্ধি প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত অবদান রেখেই চলেছে।
বাংলাদেশের একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক প্রত্মতত্ত্ব চর্চা হয় এখানেই। বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য অনুসন্ধান এবং প্রত্ম চর্চায় প্রতিনিয়ত অবদান রাখছে এই বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
প্রাণীবিদ্যা বিভাগও নব নব আবিষ্কারে ব্যস্ত। এই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ফড়িং’র তিনটি নতুন জাত আবিষ্কার করেন। একই বিভাগের অধ্যাপক ড. মনোয়ার হোসেন প্রজাপতি প্রেমিক নামেই পরিচিত। প্রজাপতি নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করে বিভিন্ন প্রজাপতির জাত আবিষ্কার করেন তিনি এবং এই বিষয়ে বহু বই লিখেছেন। এমনকি তারই উদ্যোগে বাংলাদেশের একমাত্র প্রজাপতি মেলা অনুষ্ঠিত হয় প্রতি বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আবার প্রাণীবিদ্যা বিভাগের উদ্যোগে প্রতি বছর বাংলাদেশের একমাত্র পাখি মেলা অনুষ্ঠিত হয় এই ক্যাম্পাসেই। ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো ২০১৪ সালের পাখি মেলা।
পুরো ক্যাস্পাস যেন দুর্লভ লাল মাটির ওপর ভর করে এক অন্য রকম মোহনীয়তা দান করছে। মাঝে-মধ্যে নাট্যকার সেলিম আল দীনের স্মৃতিবিজড়িত মুক্তমঞ্চে বন্ধু-বান্ধবী মিলে নাটক বা যে কোনো অনুষ্ঠান দেখার মজাই আলাদা।
বর্তমানে এই ক্যাম্পাসে প্রায় শতাধিক সামাজিক-সাংষ্কৃতিক সংগঠন রয়েছে। এসব সংগঠন শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় অনস্বীকার্য অবদান রেখে চলেছে প্রতিনিয়ত।
প্রতিষ্ঠানটির ইট কনক্রিটের কাঠামো, সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ, পিচ ঢালা নিরেট পথ খালি চোখে দেখলে শুধু জড়বস্তুই মনে হবে। কিন্তু ভেতরের অসংখ্য স্মৃতি জীবন্ত ও সজীব।
প্রিয় মানুষ ছাড়াও জমাট ইট-কাঠের তৈরি ঘর, খোলা জানালা যে কতোটা সঞ্চলণশীল তা জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থী মাত্রই জানেন। এই ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ভবনের স্থাপত্য-নকশা অনন্য বৈশিষ্টের। প্রাচীনকালের গ্রিক থিয়েটারের আদলে এবং ক্যাম্পাসের নিজস্ব ভূ-প্রাকৃতিক চরিত্র অক্ষুণ্ন রেখে খোলা আকাশের নিচে নাট্যকার সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চ ১৯৮২ সালে উদ্বোধন করা হয়। এ ধরনের জীববৈচিত্র সমৃদ্ধ ক্যাম্পাস এই উপমহাদেশে নেই বললেই চলে।
রাজধানী ঢাকা থেকে ৩২ কিলোমিটার উত্তরে সাভার উপজেলার ঢাকা আরিচা মহাসড়কের পাশে ৬৯৭.৫৬ একর (২.৮ বর্গ কিলোমিটার) আয়তনের বিশাল জায়গা জুড়ে ১৯৭০ সালে অধ্যাদেশের মাধ্যমে ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’র যাত্রা শুরু হয়। পরে ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। স্বাধীনতার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট-১৯৭৩ অনুযায়ী এর নাম হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রতিষ্ঠাকালীন ৪টি বিভাগ, ১৫০ জন শিক্ষার্থী, ২০ থেকে ২১ জন শিক্ষক এবং একটি আবাসিক হল নিয়ে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের। হাঁটিহাঁটি পা-পা করে ৪৩ বছর পাড়ি দেওয়া হয়ে গেছে । বর্তমানে ৬টি অনুষদ, ২টি ইনস্টিটিউট, ৩৪টি বিভাগ, ১২টি আবাসিক হল (ছাত্র হল ৭টি, ছাত্রী হল ৫টি) নিয়ে চলছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কার্যক্রম । এছাড়া ছেলেদের একটি ও মেয়েদের ৩টি হলের নির্মান কাজ চলছে।
প্রতি বছরের মতো এবারও গত ১২ জানুয়ারি ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ প্রতিপাদ্য বিষয় ধারণ করে এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী তথা জন্মদিন পালিত হয়েছে। প্রতিবারের মতো এবারও দিবসটি উপলক্ষে শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠনগুলো নিজ উদ্যোগে নানা ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিবসটি স্মরণীয় করে রাখে।
উদ্বোধনের পর এক বর্নাঢ্য র্যালি শেষে মুক্তমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা, স্মৃতিচারণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আর এসব অনুষ্ঠানে জাবির বর্তমান এবং সাবেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সবাই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে। তৈরি হয় এক আনন্দঘন মিলনমেলার।
প্রতিষ্ঠার ৪৩ বছর পাড় হলেও এই ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের চাওয়া-পাওয়ার শেষ হয়নি। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে আসন এবং বই সংকট রয়েছে। শিক্ষকদের অপরাজনীতির ফলে একাডেমিক শিক্ষা ব্যাহত হওয়ার গুরতর অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে বিভিন্ন সময় হানাহানির সৃষ্টি হয়। চলে প্রভাব বিস্তার আর আধিপত্যের লড়াই। এসব কারণেই সকল প্রকার একাডেমিক কার্যক্রম প্রায়ই থমকে দাঁড়ায়।
নতুন বছরে প্রতিষ্ঠার ৪৪ বছরের শুরুতে এসব সমস্যা সমাধান করতে জাবি প্রশাসন আন্তরিক এবং কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। ফলে এই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের সমৃদ্ধিতে উত্তরোত্তর অবদান রাখতে পারবে বলে প্রত্যাশা ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের।
* ওয়ালীউল্লাহ মিঠু, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ (৪র্থ বর্ষ) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সময়: ১৮২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০১৪