ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

বাংলানিউজকে অধ্যাপক আফসার

শিক্ষকদের নৃশংসতা মনে করে শিউরে উঠি

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২০ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১৪
শিক্ষকদের নৃশংসতা মনে করে শিউরে উঠি ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আফসার উদ্দিন আহমেদ। মনে দগদগে ক্ষত আর মানসিক আঘাতে জর্জরিত নাটক ও নাট্যতত্ত্বের এই অধ্যাপক।



উপ-উপাচার্য থাকাকালে তার সঙ্গে শিক্ষকদের আচরণকে ‘নৃশংসতা’ বলে উল্লেখ করে অধ্যাপক আফসার বলেছেন, তাদের সেই আচরণ আমাকে কষ্ট দেয়। মনে পড়লে এখনো শিউরে উঠি। শিক্ষকদের আচরণ এমন হতে পারে ভাবলেই লজ্জা পাই, বিস্মিত হই। এসব কারণেই ক্যাম্পাসে শিক্ষকদের মাঝে নেই সুস্থ সম্পর্ক।

তার মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের কাজে গতি নেই, নেই বলিষ্ঠতা। প্রশাসন চলছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থকদের মিশ্রণে। শিক্ষকদের নিজেদের মধ্যেও রয়েছে সম্পর্কের টানাপড়েন। দেশের একমাত্র নারী উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম ভিন্নমতের সমালোচনাকে সহ্য করতে পারছেন না। শিক্ষকদের নিগ্রহ করছেন বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি।

তার সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এসেছে নানা বিষয়। অধ্যাপক আফসার উদ্দিন আহমেদের একান্ত সাক্ষাতকার নিয়েছেন বাংলানিনিউজটোয়েন্টিফোর.কমের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট জাহিদুর রহমান।


বাংলানিউজ: উপ-উপাচার্যের পদে নেই। কেমন লাগে এখন? কোনো আক্ষেপ?

অধ্যাপক আফসার: না, কোনো আক্ষেপ নেই। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, শিক্ষক হয়েছি, প্রোক্টর ছিলাম, ডিনও হয়েছি। কোনো আক্ষেপ নেই। বরং বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে অনেক দিয়েছে। বিনিময়ে আমি কিছুই দিতে পারিনি।

বাংলানিউজ: উপ-উপাচার্যের পদে থাকাকালে এমন কোনো পরিকল্পনা, যা বাস্তবায়ন না হবার পীড়া দেয়?

অধ্যাপক আফসার: আমি বিশ্ববিদ্যালয়কে সাংস্কৃতিক রাজধানীতে রূপ দিতে চেয়েছিলাম। বার্ষিক একটি কালচারাল ক্যালেন্ডার করতে চেয়েছিলাম, যেখানে বছরজুড়েই থাকবে নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। নানা পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষার্থীরা যাতে এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে সে চেষ্টা করেছিলাম। এ ব্যাপারে উদ্যোগও নিয়েছিলাম। তবে তা শেষ করা যায়নি।

বাংলানিউজ: আর কোনো পরিকল্পনা?

অধ্যাপক আফসার: কর্মচারীদের পদোন্নতি নীতিমালা, অবকাঠামো ও আবাসন সুযোগ-সুবিধাসহ নানা বিষয়ে পরিকল্পনা ছিলো। এগুলোও বাস্তবায়িত হয়নি। আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবিক সম্পর্কের সংস্কৃতি নষ্ট হয়ে গেছে। সেটাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও করেছিলাম, হয়নি।

বাংলানিউজ: কেন এই পরিকল্পনা মাথায় এলো?

অধ্যাপক আফসার: আমার অভিজ্ঞতা থেকে এই পরিকল্পনা করেছিলাম। দাবি আদায়ের নামে আমাকে নিজ দফতরে টানা ১৪ দিন বন্দি রেখে আন্দোলনকারী শিক্ষকরা আমার সঙ্গে নৃশংস আচরণ করেছেন, নির্মম ভাষায় কথা বলেছেন। গভীর রাতে আমার ঘরে ঢুকে জোর করে ফাইলে স্বাক্ষর আদায়ের চেষ্টা করেছেন।

এখন সেসব ভাবলে আমার লজ্জা লাগে। মানসিকভাবে কষ্ট দেয়। তারা কেউ আমার ছাত্র, কেউ শিক্ষক, কেউ সহকর্মী, কেউবা বন্ধু ছিলেন। কই এখন তো তারা আমাকে ঘেরাও করেন না। তাহলে কি শুধু ওই পদে থাকার জন্যেই আমাকে এতো মানসিক অত্যাচার। ভাবি, এটার শেষ কোথায়?

বাংলানিউজ: এখন তো আপনি উপ-উপাচার্যের পদে নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন প্রশাসন।

অধ্যাপক আফসার: আমি আশা করেছিলাম, দেশের প্রথম নারী উপাচার্যের নেতৃত্বে বর্তমান প্রশাসন দক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে এ বিষয়গুলো দেখবেন। কারো প্রতি শক্রভাবাপন্ন না থেকে কাজ করবেন। কিন্তু আমরা কি দেখলাম! কোনো নোটিশ ছাড়াই বিভিন্ন পদ থেকে তাদের সরিয়ে দেওয়া হলো। এভাবে তাদের নিগৃহীত করা হলো।

বর্তমানে শিক্ষকদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে পারস্পরিক আস্থার যে অভাব, সেটা কাটানোর কোনো পদক্ষেপ কিন্তু আমরা দেখছি না।

বাংলানিউজ: আপনার দৃষ্টিতে বর্তমান প্রশাসনের মূল্যায়ন?

অধ্যাপক আফসার: একটা অদ্ভূত সম্পর্কের মধ্য দিয়ে চলছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। যেটা দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক। নেই কোথাও সুস্থ মানবিক সম্পর্ক। কোথায় যেন পরস্পরের প্রতি আস্থার অভাব। ভিন্ন মতাবলম্বী শিক্ষকদের প্রতি সুদৃষ্টি পোষণ করা হয় না। এ জায়গাগুলো থেকেই সরে আসা উচিৎ।

বাংলানিউজ: নতুন প্রশাসন এলে তাদের পছন্দমতো পরিবর্তন হবে, এটাই তো স্বাভাবিক।

অধ্যাপক আফসার: আমি স্বীকার করি, এটা স্বাভাবিক। কর্তা ব্যক্তিটি (উপাচার্য) তার পছন্দ মতো লোক দিয়েই প্রশাসন চালাবেন। কিন্তু যারা তার মতাবলম্বী নন তারা তো প্রাপ্য সম্মান ও সুযোগ আশা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা মত পথ থাকবে। কিন্তু ভিন্ন মতাবলম্বীদের নোটিশ ছাড়াই পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে তাদের সঙ্গে নিগ্রহমূলক আচরণ করা হয়েছে।

বাংলানিউজ: দেশের প্রথম নির্বাচিত নারী উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের মূল্যায়ন?

অধ্যাপক আফসার: তার সম্পর্কে মূল্যায়ন করার সময় এখনো আসেনি। আমি তাকে নিয়ে আশাবাদী ছিলাম। তবে বলবো, নির্বাচিত উপচার্য হলেই যে তিনি শিক্ষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য থাকবেন- সে ব্যাপারে কিন্তু অতীতের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না। কারণ নির্বাচিত উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে কিন্তু শিক্ষকরাই আন্দোলনের মাধ্যেমে এই ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়ণ করেছেন।

বাংলানিউজ: নতুন উপাচার্যের কাছে প্রত্যাশা কী কী?

অধ্যাপক আফসার: প্রত্যাশা এতোটুকুই যে, তিনি পরমতসহিষ্ণু হবেন। যারা তার মতাদর্শী নন, তাদের বিরুদ্ধে তিনি নিবর্তণমূলক কোনো পদক্ষেপ নেবেন না। কাউকে নির্যাতন করে যদি দমন করবেন বলে কেউ ভাবেন, তাহলে তা ভুল হবে।

বাংলানিউজ: ক্যাম্পাস থেকে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে বিতাড়ণের কথা বললেন, আপনিও তো...

অধ্যাপক আফসার: অধ্যাপক আনোয়ার পদত্যাগ করেছেন, তাকে কেউ চাপ দেননি। আমাকে ঠিক বিতাড়ণ নয়, আমাকে সরকার অব্যাহতি দিয়েছে। সরকার নিয়োগ দিয়েছে, তারা অব্যাহতি দিতেই পারে।

বাংলানিউজ: এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ?

অধ্যাপক আফসার: এখানে কষ্টের জায়গাটা হলো, আমার সরকার ক্ষমতায়, আমার পার্টি ক্ষমতায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, নেত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী। নিয়োগ পেয়েছিলাম চার বছরের জন্যে। অথচ বছর না ঘুরতেই আমাদের অব্যাহতি দেওয়া হলো। তবে বিএনপি যদি এমন করতো, তাহলে একটা কথা ছিলো, কষ্ট হতো। আওয়ামী লীগ এমন করেছে, তাই কষ্ট নেই।

বাংলানিউজ: উপ-উপাচার্যের দায়িত্ব পালনকালে কোনো অপূর্ণতা

অধ্যাপক আফসার: ইচ্ছে ছিলো সারা বছর শিক্ষার পাশাপাশি ক্যাম্পাসে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে। আমার বিশ্বাস, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিকাশ ঘটলে রাজনৈতিক হানাহানি কমে যাবে। তবে সেটাও সম্ভব হয়নি। আশা করি, এ অপূর্ণতা ভবিষ্যতে পূরণ হবে।

বাংলানিউজ: উপ-উপাচার্যের দায়িত্ব পালনের কোনো কষ্টের স্মৃতি?

অধ্যাপক আফসার: সে দিনগুলোর কথা আমি স্মরণ করতে চাই না। তবে সেগুলো আমি রেখেছি আমার ডায়েরিতে, আত্নজীবনীতে, আমার লেখনিতে। একটা সময়ের অপেক্ষায় আছি, যখন এগুলো প্রকাশ করবো। জীবন যন্ত্রণার সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে শিউরে উঠি। সেই মানসিক ক্ষত এখনো দগদগে, শুকায়নি। ফ্লোরে ঘুমাতাম। গভীর রাতে এসে হানা দিতেন আন্দোলনকারী শিক্ষকরা। তাদের সেই ‘নৃশংস’ চেহারা মনে ভেসে উঠলে খুবই কষ্ট পাই।

বাংলানিউজ: এখন দিনগুলো কেমন কাটছে?

অধ্যাপক আফসার: উপ-উপাচার্যের পদ থেকে সরে আসার পর সত্যিই আমার নিজেকে কেন যেন স্বাধীন মনে হয়। নিজের খেয়াল-খুশি মতো কাজ করছি। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে টকশো’ করছি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার ওপর পড়াচ্ছি। নাটকের নির্দেশনা দিচ্ছি, লিখছি, পড়ছি, পড়াচ্ছি। পছন্দের আরো একটি জায়গা হচ্ছে, ধ্রুপদি সাহিত্য। সেটা নিয়েও ব্যস্ত আছি।

বাংলানিউজ: শিক্ষক থেকে উপ-উপাচার্য, সেখান থেকে উপাচার্যের দৌড় থেকে পিছিয়ে পড়া। এসব থেকে কোনো হতাশা?

অধ্যাপক আফসার: আসলে আমি শিক্ষক পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। আমার কোনো হতাশা নেই। মানুষ হিসেবে আমি প্রচণ্ড আশাবাদী। আমার দর্শন হচ্ছে-বর্তমান সময়টাই বাস্তবতা। আর আমার বেঁচে থাকাটাই একটি ম্যাজিক।

বাংলানিউজ: ক্যাম্পাসে আপনার নিজ দলের কি অবস্থান?

অধ্যাপক আফসার: এখানে আওয়ামী লীগের চার/পাঁচটি গ্রুপ আছে। ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে দলটি চলছে। এটা থাকা ঠিক না। কে কি পেলেন, সেটা না ভেবে সকলের উচিৎ, দলকে এগিয়ে নেওয়া।
 
বাংলানিউজ: যদি আবার উপ-উপাচার্যের পদে ডাকা হয়, যাবেন?

অধ্যাপক আফসার: হ্যাঁ ডাকলে সাড়া দেবো। সেটা দিল্লির লাড্ডুর মতো। যে খায় সে পস্তায়, যে খায় না সেও। অন্তত আমার স্বপ্ন পূরণের জন্যে হলেও যাবো। আমার একটাই প্রশ্ন, আমি কেন তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলাম? আমি তো কারো ক্ষতি করিনি।

বাংলানিউজ: আপনাকে ধন্যবাদ

অধ্যাপক আফসার: বাংলানিউজকেও ধন্যবাদ

বাংলাদেশ সময়: ১১১৮ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।