ঢাকা: ক্ষোভে ফুঁসছেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নজিরবিহীন জালিয়াতি, টাকা লুট, অনিয়ম আর দুর্নীতির খবরে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তারা।
যে প্রতিষ্ঠানটি জাল জালিয়াতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানে সন্তানরা কী শিক্ষা নেবে- এ নিয়েই এখন ভীষণ চিন্তিত অভিভাবকমহল। আর এসব অপকর্মে ট্রাস্টি বোর্ডের যেসব সদস্য জড়িত রয়েছেন তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন তারা।
বলেছেন, স্বাক্ষর জাল করে যারা ৫০ কোটি টাকার জমি ৫০০ টাকায় ক্রয় করে অর্থ লুটের মহা আয়োজন করে, তারা কোনোভাবেই শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে সংযুক্ত থাকতে পারেন না।
ছাত্রদের কয়েকশ’ কোটি টাকা যারা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছেন, তাদের হাতে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানটি নিরাপদ নয়। অবিলম্বে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দিয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি জানিয়েছেন তারা। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড সদস্যদের দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা অনিয়মের তথ্য প্রকাশের পর অভিভাবকেরা স্তম্ভিত হয়ে পড়েছেন। চিন্তিত তারা তাদের সন্তানের শিক্ষাজীবন নিয়ে।
হতবাক দেশের অন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও। তারা বলেছেন, দুদকের মাধ্যমে এই অনিয়মের তদন্ত হওয়া দরকার। প্রতিষ্ঠানটি রক্ষার স্বার্থে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। অন্যথায় ধ্বংসের মুখে পড়বে এই শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানটি।
অভিভাবকেরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে ধরেছেন। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষক এবং কর্মকর্তা নিগৃহীত হয়েছেন, তারাও মুখ খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বিশেষ করে যেসব নারী কর্মকর্তা ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য শাজাহানের কাছে বিভিন্ন সময়ে শ্লীলতাহানির শিকার হতে যাচ্ছিলেন তারাও এবার সোচ্চার হতে শুরু করেছেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই। উগ্র-মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদি কর্মকাণ্ডের কারণে আলোচনায় উঠে আসে দেশের প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য শাজাহানের নারী কেলেঙ্কারির খবর ফাঁস হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়টি ফের আলোচনায় উঠে আসে। শাজাহানের এহেন কর্মকাণ্ডে এখানকার শিক্ষার্থীরাও ক্ষুব্ধ।
রক্ষকই ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের কতিপয় সদস্য ছাত্রদের টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নেওয়ার খবর ফাঁস হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়টির ভবিষ্যৎই এখন প্রশ্নবিদ্ধ।
অনেক অভিভাবক এরই মধ্যে তাদের সন্তানদের শিক্ষা ক্ষেত্র পরিবর্তনের কথা ভাবছেন। তারা বলছেন, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা বোর্ড জাল জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা লুটপাট করে, মাস্তান নিয়ে চলাফেরা করেন, তারা কীভাবে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করবেন। তাই তার সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিবর্তনের কথা ভাবছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক এবং অভিভাবকদের অনেকেই বলেছেন, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের নামে ট্রাস্টি বোর্ডের কতিপয় সদস্য এটিকে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান বানিয়েছেন। তাদের স্বেচ্ছাচারিতায় পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জিম্মি হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের কয়েকশ’ কোটি টাকা তারা নিজেদের ইচ্ছামতো তুলছেন, খরচ করছেন। আইনের তোয়াক্কা না করেই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য শাজাহানের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিনদিন যেন বাড়ছেই। তার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানিসহ নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে। একাধিক নারী কর্মকর্তা জানান, সময়ে অসময়ে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য মো. শাজাহান তার কক্ষে ডেকে পাঠান। তার কক্ষে গেলে নানান অশ্লীল কথা বার্তা শুনতে হয়। নর্থ সাউথে এখন আর চাকরি করার পরিবেশ নেই। অভিযোগ করার জায়গাও নেই।
এছাড়া টাকা লুটেরও অভিযোগ রয়েছে শাজাহানের বিরুদ্ধে। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি থাকাকালীন সময়ে মো. শাজাহান নর্থ সাউথ ফাউন্ডেশনের নামে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাধারণ তহবিল থেকে ১১৪ কোটি টাকার বেশি সরিয়ে নিয়েছেন। এ ছাড়াও তার পুত্রবধূকে নন ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি দেখিয়ে অনৈতিক প্রত্যয়নপত্র প্রদান করাসহ তার বিরুদ্ধে এক শিক্ষিকাকে শ্লীলতাহানিরও অভিযোগ ওঠে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৮/৯ মাসে শাজাহানের কারণে স্কুল অব বিজনেস ফ্যাকাল্টি’ থেকে চাকরি ছেড়েছেন ড. সালাউদ্দিন আহমেদ, ড. ফয়জুল কবির, ড. আবদুর রব, ড. মীর ওবায়দুর রহমান, ড. আবদুল হান্নান চৌধুরী, ড. জি মুহাম্মদ, ড. শরিফ নুরুল আকরাম, ড. সাদ হোসেন, ড. আলমগীর হোসেন। নন-পিএইচডি ধারীদের মধ্যে ফারজানা ফিরোজ, ফারহানা ইসলাম গালিব মহিউদ্দিন, রাইসুল ইসলাম, কামরুল আরেফিন, মোল্লা-ই মজিদ, বশীর হোসেন, শাহেদুর রহমান, মেহেদী হোসেন, আরিফ গনি, শাহরিয়ার একরাম, মুহাম্মদ শামসি, জসিম উদ্দিন, মমিনুল হক তালুকদার, মঞ্জুরুল হক, রাকিব হোসেন, খান মো. নোভো, মো. শরিফ, খান মুশফিকুর, শাকিল হায়দার, এস হোসেন, নিয়াজ পাটোয়ারী।
প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধর্মীয় উগ্র-মতবাদ ছড়ানো ও তাদের ‘জঙ্গিবাদ’-এ উদ্বুদ্ধ করার গোপন তৎপরতায় প্রতিষ্ঠানটির কিছু শিক্ষক-কর্মকর্তা জড়িত বলে গোয়েন্দাদের কাছে খবর আছে। যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনার অভিযোগে রেজওয়ানুল আহসান নাফিসের গ্রেফতার, ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবির ও হিযবুত তাহ্রীর কর্মকাণ্ডের অভিযোগের পর, ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যাকারীদের তালিকায় চলে আসে আলোচিত এ প্রতিষ্ঠানটির উগ্রবাদী পাঁচ ছাত্রের নাম।
জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের দায়ে প্রতিষ্ঠানটিতে এ পর্যন্ত এক শিক্ষক আটক ও পাঁচ শিক্ষক বহিষ্কার হয়েছেন। পাঁচ ছাত্রের আটক ছাড়াও বহিষ্কার করা হয়েছে ১৪ ছাত্রকে। তাদের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের প্রত্যক্ষ অভিযোগ ওঠায় বহিষ্কার করা হলেও প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি রক্ষার নামে বলা হয়েছে, পরীক্ষা না দেওয়া, খারাপ ফলসহ নানা দুর্বলতার কথা।
সূত্র জানায় উচ্চবিত্তের কাছে বাইরে থেকে একটা ভালো ইমেজ তৈরি হলেও দিনের পর দিন জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ট্রাস্টি বোর্ডের তিন সদস্য। নিয়মিত নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে হিযবুত তাহরীরের বীজ ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
১৯৯২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে এর উত্থান ঘটতে থাকে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা ভিসি ছিলেন ডানপিন্থ ও বিএনপির মতাদর্শী এক অধ্যাপক। উদ্যোক্তা হিসেবে আরও ছিলেন যারা তাদের প্রত্যেকের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে এ ক্ষেত্রে জামায়াতের এক নীতিনির্ধারক শুরু থেকেই ট্রাস্টি হিসেবে রয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৪