ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

প্রিয় বৃক্ষের জন্য শোক-প্রতিবাদ

সাখাওয়াত আমিন, ইউনিভার্সিটি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১৪
প্রিয় বৃক্ষের জন্য শোক-প্রতিবাদ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: একটি গাছে নয়, যেন করাত চালানো হল হাজারো শিক্ষার্থীর বুকে। প্রিয়জনকে হত্যা করলে মানুষ যেমন শোকে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে, গাছটি কেটে ফেলায় শিক্ষার্থীরা যেন তেমনই স্তম্ভিত।

কারণ গাছটিই যে এ ইট-বালুর শহরে তাদের একান্ত প্রিয়জনের মত ছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীম উদদীন হলের মূল ফটকের সামনেই ছিল একটি অ্যারোকেরিয়া গাছ, যেটা শিক্ষার্থীদের কাছে ক্রিসমাস বৃক্ষ নামেই পরিচিত ছিল। হলের প্রতিষ্ঠাকালে (১৯৭৬) গাছটি লাগানো বলে জানা যায়।

কিন্তু গত বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) কাউকে কিছু না জানিয়েই হাজারও শিক্ষার্থীর স্মৃতিবিজড়িত গাছটি কেটে ফেলে হল প্রশাসন।

দুপুরে গাছটি কেটে ফেলার পরপরই কড়া সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। তখনই প্রতিবাদ জানানোর সিদ্ধান্ত হয়ে যায়।

বৃহস্পতিবার রাতেই হলের মূল ফটকের সামনে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা তৈরি করেন ‘নিন্দা চত্বর’। কেটে ফেলা গাছটিকে ‘শহীদ বৃক্ষ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে শিক্ষার্থীরা গাছ কাটাকে ‘গাছ কাটার শৈল্পিক বিপ্লব’ হিসেবে আখ্যা দেন। কারণ এর আগেও প্রশাসন অনেক গাছ কেটে ফেলেছে।

শুধু ‘নিন্দা চত্বর’ করেই প্রতিবাদ শেষ হয়নি তাদের। গাছটিকে ঘিরে শিক্ষার্থীদের স্মৃতিকথন নিয়ে রচিত একটি কাগজও টাঙানো হয়েছে ‘নিন্দা’ চত্বরে।

শুক্রবার দুপুরে তারা কেটে ফেলা গাছটির গোড়ায় কালো পতাকা টাঙিয়ে দিয়েছেন। এরপর চারদিক থেকে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে মানববন্ধন করেছেন।

মানববন্ধনেও যেন ছিল শোকের চিহ্ন। কারণ মানববন্ধনের ব্যানার ছিল কালো কাপড়ের জমিনে সাদা অক্ষর। ব্যানারে লেখা ছিল ‘হলের প্রতিষ্ঠাকালীন বৃক্ষ ও সৌন্দর্যবর্ধক ‘ক্রিসমাস বৃক্ষটি কেটে ফেলার প্রতিবাদে মানববন্ধন’।

সেখানে অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। কয়েকজন শিক্ষার্থীর বক্তব্যেও ফুটে উঠছিল শোক আর ক্ষোভের ঝালালো মিশ্রণ।

শিক্ষার্থীরা বলেন, মানুষ মানুষের শত্রু হয়। কিন্তু গাছ কীভাবে মানুষের শত্রু হয়। এটি শুধু একটি গাছ নয়, ছিল আমাদের প্রিয়জনের মতই। কারণ এ গাছের সঙ্গে মিশে আছে আমাদের সুখ-দুঃখ ও আনন্দের-বেদনার স্মৃতি।

হাতে রাখা প্ল্যাকার্ডও যেন প্রতিবাদের এক একটি অমোঘ বাণী। তাতে লেখা ছিল, ‘যে গাছের শত্রু, সে দেশের শত্রু’। ‘আমাদের বন্ধু বৃক্ষ হত্যার বিচার চাই’, ‘যে একটি গাছ কাটতে পারে সে একটি মানব জাতিকে হত্যা করতে পারে’, ‘গাছের সাথে কীসের শত্রুতা?’। লেখাগুলো যেন তাদের শোক ও ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ।

এই গাছসহ হলের অনেক গাছ কেটে ফেলায় এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্বৈরাচারী আচরণের অভিযোগ তুলে কবি জসীম উদদীন হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক রহমত উল্লাহর পদত্যাগও দাবি করা হয় মানববন্ধন থেকে।

নিজেদের ‘প্রিয়জনকে’ হত্যার জন্য প্রকাশ্যে দুঃখ প্রকাশের দাবিও করেন শিক্ষার্থীরা।

তারা বলেন, যতদিন পর্যন্ত প্রভোস্ট প্রকাশ্যে এই ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে নতুন গাছ রোপণ না করবেন, ততদিন এখানে কালো পতাকা থাকবে।

মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন হলের শিক্ষার্থী শেখ নুর আলম, আলী ইমরান, জহিরুল, শিমুল, আবির প্রমুখ।

এদিকে, গাছটি কাটার নিন্দা জানিয়েছে কবি জসীম উদদীন হল শাখা ছাত্রলীগও। তারা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে।

হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ গাছটির একটি বিশেষত্ব ছিল। অন্যান্য সাধারণ গাছের মত ছিল না এটি। জন্মের পর থেকেই বড় হতে হতে ধীরে ধীরে বেঁকে যায়। এক সময় একটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি ধারণ করে। যা তার সোন্দর্য আরও বৃদ্ধি করে।

শিক্ষার্থীরা জানান, গাছটি শুধু একটি গাছই ছিল না, এটি ছিল হলের একরকমের বিশেষ আইডেন্টিটি। কারণ আমরা অন্য হলের শিক্ষার্থীদের কাছে বা বাইরের কোনো লোকের গাছে গর্ব করে বলতাম, আমাদের হলে একটি বিশেষ গাছ আছে, যা পৃথিবীর কোথাও নেই।

গাছটি কেন হঠাৎ কেটে ফেলা হল? জানতে বারবার হল প্রভোস্ট অধ্যাপক রহমত উল্লাহকে ফোন দিলেও তিনি ফোন ধরেননি।

হলের আবাসিক শিক্ষক ড. মো. রবিউল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, আমি যতদূর জানি। হল মিটিংয়ে একদিন গাছটি কেটে ফেলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। কারণ আরবারিকালচারের লোকজন নাকি গাছটি দেখে এটিকে ঝুকিপূর্ণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। আরবারিকালচার সেন্টারের পরিচালক স্বাক্ষরিত একটি চিঠিও হল কর্তৃপক্ষ পেয়েছে বলে জানান তিনি।

এ ব্যাপারে ঢাবি আরবারিকালচার সেন্টারের পরিচাল অধ্যাপক মিহির লাল সাহার কাছে জানতে চাইলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।

তার স্বাক্ষরিত চিঠির ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, হতে পারে, তবে অনেক দিন আগের তো, তাই বিষয়টি আমার মনে নেই।

গাছটির ব্যাপারে কবি জসীম উদদীন হলের সাবেক প্রভোস্ট এবং বর্তমান কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, আমি প্রভোস্ট থাকাকালীন অনেকে আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন গাছটি কেটে ফেলার জন্য। কিন্তু আমি শুনিনি। কারণ গাছটি অনেক সুন্দর ছিল।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।