ঢাকা, সোমবার, ২২ আশ্বিন ১৪৩১, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৩ রবিউস সানি ১৪৪৬

শিক্ষা

বাকৃবি গবেষকের সাফল্য

বৈরী আবহাওয়ায় চাষ উপযোগী ধানের জাত উদ্ভাবন

বাকৃবি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২১১ ঘণ্টা, মে ২৬, ২০১৫
বৈরী আবহাওয়ায় চাষ উপযোগী ধানের জাত উদ্ভাবন

বাকৃবি: বৈরী আবহাওয়ায় চাষ উপযোগী উচ্চ ফলনশীল ধানের একটি জাত উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিশেষজ্ঞ ড. মো. নাজমুল হক শাহিন।

এর মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষিতে বিপ্লবের সম্ভাবনা দেখছেন তিনি।



ড. শাহিন নিজস্ব অর্থায়নে গত ১৯ বছর ধরে এ জাতের ধান উদ্ভাবনে গবেষণা করে আসছেন। তার এই গবেষণা কাজে বিগত দুই বছর ধরে সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করছেন বাকৃকি থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন আনিছার রহমান নামে এক শিক্ষার্থী।

সুদীর্ঘ ১৯ বছর গবেষণার পর ট্রান্সগ্রেসিভ সেগ্রিগেন্ট ব্রিডিং (মাতৃ ও পিতৃ গাছ অপেক্ষা উদ্ভাবিত জাতের গুণাগুণ অধিকতর উত্তম) এর মাধ্যমে কৃত্রিম সংকরায়ন ঘটিয়ে দেশি ধানের জাত থেকে উচ্চ ফলনশীল এ জাতের ধান উদ্ভাবন করেন ড. শাহিন।

এ বিষয়ে তিনি বাংলানিউজকে জানান, এ গবেষণার জন্য তিনি প্রচলিত দেশি প্রজাতির একটি ধানকে বেছে নেন। সংগ্রহকৃত ওই ধানের জাতের নামকরণ করেন ‘দোলা আমন’। দোলা আমনের কৃত্রিম সংকরায়ন করে নতুন জাত উদ্ভাবন করেন। তার উদ্ভাবিত ওই ধান থেকে বিঘাপ্রতি ১১ মণ ফলন পান।

তিনি জানান, তার উদ্ভাবিত ধানের জাতগুলোর মূল বৈশিষ্ট্য হলো, এ ধানের উচ্চতা ৯৫-১৩৫ সেমি এবং কাণ্ড ও বায়োমাস অনেক বেশি। আর তাই ৮০-৯৬ কিমি বেগে ঝড় হলেও গাছ জমিতে হেলে পড়ে না। রোপণকৃত একটি চারা হতে প্রতিটি গাছে সর্বনি¤œ ১০টি হতে সর্বোচ্চ ২৮টি কুশি উৎপন্ন হয়। প্রতিটি ধানের শীষের দৈর্ঘ্য ২৫ সেমি থেকে ৪০ সেমি। প্রতি শীষে পুষ্ট দানার সংখ্যা ২৫০টি হতে ৩৫০টি।

তিনি আরো জানান, ধানের জাতগুলো প্রচলিত ধানের জাত অপেক্ষা তিন ভাগের এক ভাগ কম সার প্রয়োগ করে চাষাবাদ করা সম্ভব। উদ্ভাবিত নতুন ধানের জাতগুলোতে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ নাই বললেই চলে। নতুন ধানের জাতগুলো আউশ, আমন এবং বোরো মৌসুমেও চাষ উপযোগী। এগুলো নিচু হতে উঁচু জমিতে চাষ করা যায়। এর জীবনকাল ১০৫ থেকে ১৪৫ দিন এবং নি¤œ তাপমাত্রা, লবনাক্ততা ও জলাবদ্ধতা সহনশীল।

‍ড. শাহিন জানান, দোলা আমন ধানের কৃত্রিম সংকরায়ন ও প্রোজেনী নির্বাচনের মাধ্যমে ৮৫০টি নতুন উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন যা দেশি ধানের জাতের চেয়ে উন্নত। এ ধানের গড় ফলন বিঘাপ্রতি ৩৩-৪০ মণ যা দোলা আমন ধানের জাতের ফলন অপেক্ষা ৩ গুণ বেশি।

তিনি জানান, হাওরে চাষ উপযোগী অনেকগুলো ধানের জাতও এতে অন্তর্ভূক্ত আছে। ধানের চাল সাদা, লম্বা চিকন, মাঝারি চিকন ও মাঝারি রকমের মোটা এবং খেতে সুস্বাদু। এই ৮৫০টি ধানের জাতের মধ্য বেশ কয়েকটি রপ্তানিযোগ্য সুগন্ধি ধানের জাতও আছে।

এদিকে, বাকৃবির কৃষিতত্ত্ব বিভাগ এবং কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের এক গবেষণায় উদ্ভাবিত ধানের জাতগুলো নাইট্রোজেন সাশ্রয়ীতার প্রমাণ মিলেছে। কোনো প্রকার নাইট্রোজেন সার ব্যবহার না করে শুধুমাত্র গোবর, এমওপি ও টিএসপি সার প্রয়োগ করে ব্রি-ধান ২৯ অপেক্ষা হেক্টর প্রতি ১ টন বেশি ফলন পাওয়া সম্ভব।

নতুন উদ্ভাবিত পুষ্টিগুণের বিষয়ে ড. শাহিন জানান, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরসি) পরীক্ষাগারে পুষ্টিমাণ পরীক্ষায় ওই ‍ধানের চালে সর্বোচ্চ আয়রনের পরিমাণ ৫৮.০৮ পিপিএম পাওয়া গেছে, যা আয়রনসমৃদ্ধ ধানের জাত অপেক্ষা ৭ গুণ বেশি। জাতগুলোর চালে সর্বোচ্চ জিংকের পরিমাণ ৪৬.৩৮ পিপিএম পাওয়া যায় যা ব্রি-ধান ৬৪ অপেক্ষা দ্বিগুণের বেশি।

তিনি বলেন, গত বোরো মৌসুমে (২০১৩-১৪) ফলন পরীক্ষায় হেক্টরপ্রতি সর্বনি¤œ ৭.৫ টন হতে সর্বোচ্চ ১৩ টন ফলন পাওয়া যায়। আর চলতি বোরো মৌসুমে (২০১৪-১৫) বগুড়ার গাবতলী উপজেলার হাতীবান্দা গ্রামে ৮৫০টি ধানের জাত বিভিন্ন প্রকার ধানের জমিতে কৃষকের ব্যবস্থাপনায় চাষাবাদ করা হয়। সেখানে ২৫টি জাতের ক্রপ কার্টিং করে হেক্টরপ্রতি সর্বনি¤œ ৯ টন (বিঘা প্রতি ৩২ মণ) এবং সর্বোচ্চ ১২ টন (বিঘা প্রতি ৪৪ মন) ফলন পাওয়া গেছে।

বগুড়ার গাবতলী উপজেলার কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা নাজমুল হক মন্ডল মাঠ পরিদর্শনকালে জানান, দেশি ধানের জাতে ফলন বৃদ্ধি করার এটি সবচেয়ে বড় ঘটনা। ড. শাহিনের উদ্ভাবিত ধানের জাতগুলো পৃথিবীতে ধান সম্পর্কিত গবেষণায় এক নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে আশা করছি। তার গবেষণায় সফলতা লাভের ফলে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ফলনশীল দেশি ধানের ইনব্রিড জাত উদ্ভাবনের কৃতিত্ব অর্জন করবে যা বিজ্ঞানীদের বর্তমান ধান সম্পর্কিত অনেক ধারণা পাল্টে দিতে সক্ষম।

উদ্ভাবিত নতুন ধানের জাতগুলোর জেনোম সিকোয়েন্সিং এর মাধ্যমে প্যাটেন্ট করে বাংলাদেশ সরকার দেশের জাতীয় সম্পদে অন্তর্ভূক্ত করে ধান গবেষণাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে পরামর্শ দেন তিনি।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বগুড়ার উপ-পরিচালক চন্ডিদাস কুন্ডু বলেন, ড. শাহিনের গবেষণালব্ধ ফলাফল দেখেছি। অন্যান্য দেশি জাতের তুলনায় তার উদ্ভাবিত জাতের ফলন অনেক বেশি এবং পুষ্ট। এখন কৃষকের মাঠে বড় আকারে প্রদর্শনী স্থাপন করে গবেষণার পরামর্শ দিয়েছি।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে ড. শাহিন জানান, বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের কৃষকরা ধানের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। উৎপাদন খরচের চেয়ে অনেক কম মূল্যে ধান বিক্রি হচ্ছে। আমার উদ্ভাবিত ওইসব জাতের বীজ ব্যবহার করে কৃষকরা উৎপাদন ব্যয় মিটিয়ে বিঘাপ্রতি ১৫ হাজার টাকা লাভবান হতে পারবেন বলে আশা করছি। তাছাড়া আমার রোগ-বালাই কম হওয়ায় দরুণ সার ও কীটনাশক কম লাগায় উৎপাদন খরচও অনেক কমে আসবে।

তিনি বলেন, বর্তমানে গবেষণার পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় নিজস্ব অর্থায়নে গবেষণা পরিচালনা করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। সরকার ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সহায়তা পেলে গবেষণা কাজটি আরও ভালভাবে করা যাবে।

তিনি আরো বলেন, কৃষকদের স্বল্পমূল্যে উদ্ভাবিত নতুন জাতের ধানের বীজ বিতরণ করাই তার মূল লক্ষ্য। সরকার দার উদ্ভাবিত জাতের বীজ বাজারজাত করার অনুমোদন দিলে তিনি স্বল্প খরচে কৃষকের মধ্যে বীজ সরবরাহের ব্যবস্থা করবেন।

বাংলাদেশ সময়: ০২০২ ঘণ্টা, মে ২৬, ২০১৫
এসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।