ঢাকা, মঙ্গলবার, ২২ আশ্বিন ১৪৩১, ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৪ রবিউস সানি ১৪৪৬

শিক্ষা

দূরত্ব ঘুচিয়েছে অনলাইন স্কুল, শিক্ষাও গুণগত

ইসমাইল হোসেন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০২ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১৫
দূরত্ব ঘুচিয়েছে অনলাইন স্কুল, শিক্ষাও গুণগত ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

টেকনাফ, কক্সবাজার থেকে: ওয়েব ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ‘অ’, ‘আ’, ‘এ’, ‘বি’, ‘সি’, ‘আতা গাছে তোতা পাখি’, ‘টুইঙ্কেল টুইঙ্কেল’, ‘ওই দেখা যায় তাল গাছ’- বর্ণমালা-কবিতা আবৃত্তি করছিলেন সাড়ে চার বছরের শিশু ইশা।

বড় পর্দায় ভেসে উঠছে ক্লাসের পাঠ, তার এক কোণে শিক্ষক সাজিয়া আফরিন উৎসাহ যোগাচ্ছেন ছোট্ট ইশাকে।

শেখাচ্ছেন, আবার পরীক্ষাও নিচ্ছেন তিনি। অর্ধশত কচিকাঁচা তালি বাজিয়ে আনন্দমুখর করে রেখেছে ছোট কক্ষ। শ্রেণিকক্ষে আরও দু’জন শিক্ষক (মেন্টর) উপস্থিত থেকে সামলাচ্ছেন শিশু শিক্ষার্থীদের।

ঢাকা শহর থেকে প্রায় ছয়শ’ কিলোমিটার দূরে ঢাকার শিক্ষকের কাছে সমুদ্রকন্যা কক্সবাজার জেলা শহর থেকে ৯৩ কিলোমিটার দূরের উপজেলা টেকনাফ, আরও তিন কিলোমিটার দূরে খোনকারপাড়া অনলাইন স্কুলের একটি ক্লাসের চিত্র এটি।

গ্রামীণফোনের সহযোগিতায় জাগো ফাউন্ডেশন ও অগ্নি’র উদ্যোগে ঢাকার রায়ের বাজারে স্থাপিত স্টুডিও থেকে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের মাধ্যমে প্রায় ছয়শ’ কিলোমিটার দূরে এভাবে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুবিধা বঞ্চিত অর্ধশত শিশু।

খোনকারপাড়া স্কুলে গিয়ে দেখা যায় এই চিত্র।

শুধু খোনকারপাড়া স্কুল নয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের আরও নয়টি স্কুলে এভাবে শিক্ষা দিতে সহায়তা করছে গ্রামীণফোন।

স্কাইপ এর মাধ্যমে লাইভ যোগাযোগ করা যায়, তাহলে শিক্ষা দেওয়া যাবে না কেন- এ ধারণা থেকে ২০১১ সালে প্রথম অনলাইন স্কুলের যাত্রা শুরু হয়, বাংলানিউজকে এ কথা বলেন, জাগো ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ম্যানেজার (কমিউনিকেশন বিভাগ) নদী রশীদ।

তিনি বলেন, গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা দেওয়াই অনলাইন স্কুলের উদ্দেশ্য।

তারও আগে ২০০৭ সাল থেকে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সংগঠন ‘জাগো ফাউন্ডেশন’ সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য সাধারণ স্কুল পরিচালনা করে আসছিল।

একটি পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণফোনের সহায়তায় গাজীপুরে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করা হয় অনলাইন স্কুল।

কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকার রায়ের বাজারে স্থাপিত স্টুডিও থেকে ‘অনলাইন শিক্ষক’ পাঠ দেন, ইন্টারনেটের মাধ্যমে তা পাঠিয়ে দেওয়া হয় অনলাইন স্কুলের শ্রেণিকক্ষের শিশু শিক্ষার্থীদের মধ্যে।

‘অনলাইন শিক্ষক’ সরাসরি পাঠ দেন-পরীক্ষা নেন বলে জানান হাফিজুর রহমান, যিনি গ্রামীণফোনের কমিউনিকেশনস বিভাগের কর্পোরেট রেসপন্সিবিলিটি স্পেশালিস্ট। কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটির মাধ্যমে উচ্চ গতির ইন্টারনেট সেবা দিয়ে এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে গ্রামীণফোন।

খোনকারপাড়া অনলাইন স্কুলে ক্লাসের ফাঁকে শিক্ষার্থী ইন্দিরা শর্মা ইশা জানায়, ক্লাস তার খুব ভালো লাগে। পর্দার কোণে অনলাইন শিক্ষককে দেখিয়ে বলে ‘ওই আপা ভালো ক্লাস নেয়’।

আরেক শিক্ষার্থী নুরুল আফসারের ভাষ্য একই, টিভিতে আপা ক্লাস নেন, এই স্কুল খুব ভালো লাগে।

সুবিধাবঞ্চিত, স্থায়ী পরিবার ও বাবা-মায়ের আগ্রহ রয়েছে- এমন চার থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের স্কুলে ভর্তি করা হয় বলে বাংলানিউজকে জানিয়েছেন জাগো ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ম্যানেজার (এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম) জাহিদ উজ জামান।

টেকনাফের এই স্কুলের অন্তত নয়জন নরসুন্দরের (নাপিত) ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করে। মায়েরা প্রতিদিন তাদের স্কুলে নিয়ে আসেন।

স্কুলের বারান্দায় বসে থাকা ডেলপাড়ার শিক্ষার্থী বিতুশীর মা রত্না শীল বলেন, আমার আরেক ছেলে ক্লাস ফোরে পড়ে। তার চেয়ে অনলাইন স্কুলে পড়া বিতুশী ভালো শিখছে।

কেটিবিল এলাকার আরেক অভিভাবক সিকা রাণী বলেন, স্কুলটি আমারও ভালো লাগছে, আমার মেয়ে শর্মারও ভালো লেগেছে। একদিনও স্কুল বাদ দেয় না আমার বাচ্চা।

তার কথায় সায় দিয়ে স্কুলের দুই মেন্টর নাবিলা ইমান ও শিল্পী শর্মা বলেন, ছোট হলেও বাচ্চাদের শেখার আগ্রহ অনেক। অনলাইনে ক্লাস ছাড়াও নেওয়া হয় পরীক্ষা।

স্কুল থেকেই শিক্ষার্থীরা বই-খাতা-কলম, সাবান-শ্যাম্পু, জামা-কাপড় পেয়ে থাকে বলে জানান অভিভাবকেরা। স্কুলের সময় সকাল নয়টা থেকে দুপুর সোয়া ১২টা।

খোনকারপাড়া অনলাইন স্কুলের প্রজেক্ট ম্যানেজার সাইদুল ইসলাম মিঠু বলেন, গতানুগতিক স্কুল থেকে ভিন্ন হওয়ায় এই স্কুলের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ অনেক বেশি। এসব শিশু ভবিষ্যতে অনেক ভালো করবে বলেও আশা তার।

পাঁচ বছরের নিচে ‘রিসিপশন’ স্তরে ভর্তি হওয়া এসব শিক্ষার্থীকে এইচএসসি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন গ্রামীণফোন ও জাগো ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা।

২০১৩ সালে বান্দরবান, রাজশাহী, মাদারীপুর ও গাইবান্ধা; এই চারটি স্কুল প্রতিষ্ঠার পর ২০১৪ সালে অনলাইন স্কুল প্রতিষ্ঠা পায় টেকনাফ, হবিগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, দিনাজপুর ও বগুড়ায়। ২০১১ সালে গাজীপুরে প্রতিষ্ঠিত প্রথম স্কুলটির শিক্ষার্থীরা এখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে।

বর্তমানে ১০ স্কুলে ৬৯০ জন শিক্ষার্থী, ২৩ জন অনলাইন টিচার ও ফিজিক্যাল টিচার-মেনটোর রয়েছেন ৪৬ জন। অনলাইন স্কুলে তুলনামূলক ঝরে পড়ার সংখ্যা কম। গত বছর পর্যন্ত যা ছিল ১১ জন।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্য পুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সিলেবাস অনুযায়ী স্কুলগুলোতে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হয় বলে জানান কর্মকর্তারা।

ঢাকার রায়ের বাজারে অত্যাধুনিক স্টুডিওতে ১০টি বুথ দিয়ে ২০টি স্কুল চালানো সম্ভব বলেও জানান উদ্যোক্তারা।

বাংলাদেশ সময়: ২১০২ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১৫
এমআইএইচ/এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।