ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

শিবালয়ের চরাঞ্চলে ঝিমিয়ে চলছে ৫ স্কুলের পাঠদান

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৯
শিবালয়ের চরাঞ্চলে ঝিমিয়ে চলছে ৫ স্কুলের পাঠদান

মানিকগঞ্জ: মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার পাঁচটি দুর্গম চরাঞ্চলের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে। কোনো মতে দুই শিফটে জোড়াতালি দিয়ে পাঠদান করছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। 

এ পাঁচটি বিদ্যালয়ে সরকার অনুমোদিত শিক্ষক পদ রয়েছে ২৮টি। চারটি বিদ্যালয়ে শিক্ষক আছেন মাত্র ১৬ জন।

বাকি একটি বিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষক নেই।

দুর্গম চরাঞ্চলের প্রত্যেক বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকটের কারণে পাঠদান মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, উপজেলা সদর এলাকার বিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক থাকলেও দুর্গম এলাকার বিদ্যালয়গুলোতে বদলি বা নিয়োগ দেওয়া হলে শিক্ষকরা থাকতে চান না। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পছন্দমত বিদ্যালয়ে বদলি হচ্ছেন শিক্ষকরা।  

অন্যদিকে আবার কোনো কোনো বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকা বছরের পর বছর একই বিদ্যালয়ে কর্মরত আছেন।

শিবালয় উপজেলা শিক্ষা অফিসারের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, শিবালয়ের চরাঞ্চলের আলোকদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদ রয়েছে সাতটি। শিক্ষক আছেন মাত্র চারজন। শিক্ষার্থী রয়েছে ১০৮ জন। রঘুনাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদ রয়েছে পাঁচটি। শিক্ষক আছেন চারজন। শিক্ষার্থী আছে ৩৪৬ জন। কানাইদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদ রয়েছে পাঁচটি অথচ এ বিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষক নেই। শিক্ষার্থী আছে ১৬৪ জন। টেংগরহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদ রয়েছে পাঁচটি। শিক্ষক আছেন চারজন। শিক্ষার্থী আছে ৩৪৪ জন। মধ্যনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদ রয়েছে ছয়টি। শিক্ষক আছেন চারজন। শিক্ষার্থী আছে ৩২৯ জন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শিবালয়ের এ পাঁচটি বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকটের কারণে পাঠদান যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি স্কুল থেকে ঝড়ে পড়ার প্রবণতাও বাড়ছে অনেক শিক্ষার্থীর। অধিকাংশ শিক্ষক নদীর এপার থেকে ওপারে গিয়ে বিদ্যালয়ে পাঠদান করাচ্ছেন। এ সমস্ত বিদ্যালয়ে যেতে নৌপথে সময় ব্যয় হয় প্রায় এক ঘণ্টার ওপরে। সকাল সাড়ে ৯টায় জাফরগঞ্জ ঘাট ও তেওতা থেকে নৌকা ছাড়ে। নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছাতে বেলা ১১টা। তারপর সেখান থেকে হেঁটে যেতে লাগে আরও এক ঘণ্টা। এসময় পাঠদান করান স্থানীয় প্যারা শিক্ষক ও বিদ্যালয়ের দপ্তরিরা। সূর্য যখন ঠিক মাথার উপর, তখন তরিঘড়ি করে পুনরায় ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে যান শিক্ষকরা। কারণ শেষ নৌকা দুপুর ২টায়। মিস করলে সারারাত থাকতে হবে এ দুর্গম চরাঞ্চলে। বিদ্যালয়ের বাকি ক্লাসগুলো তখন নেন কোনো প্যারা শিক্ষক বা দপ্তরিরা। এতে এ সমস্ত বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত পাঠদান থেকে একদিকে যেমন বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে নৈতিকতা থেকে বিরত থাকছেন বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। আবার কোনো কোনো বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অসুস্থতার অজুহাতে বিদ্যালয়ে না গিয়ে দুই বা তিন হাজার টাকার বিনিময়ে রাখছেন প্যারা শিক্ষক।

আলোকদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থী রাশেদ মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, আমি প্রতিদিন সকালে স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ক্যারামবোর্ড খেলি। স্যারেরা এলে তারপর ক্লাস করে বাড়ি যাই। স্যারেরা আমাগো পড়াইয়া চলে যায়। তারপর ভাই (দপ্তরি) আমাগো পড়ায়।

আলোকদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মতিউর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, বিদ্যালয়ে যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে নৌপথ। আর নৌকা ছাড়ে সকাল সাড়ে ৯টায়। স্কুলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা ১১টা বেজে যায়। এ সময়টুকু বিদ্যালয়ে পাঠদান করেন দপ্তরি। যেহেতু দুপুর ২টায় শেষ নৌকা, সেজন্য বিরতিহীনভাবে ক্লাস নেওয়া হয় বিদ্যালয়ে। ২টার নৌকা মিস করলে সারারাত চরাঞ্চলে থাকতে হবে এ কারণেই আমাদের সবচেয়ে বেশি সমস্যা। আবার একদিকে বিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষক সংকট, অন্যদিকে যমুনার ভয়াল ভাঙণের কারণে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এ বছর দু’বার ভাঙনের কবলে পড়ছে বিদ্যালয়টি। যে কারণে আমরা এখন আলোকদিয়া চরের পরিত্যক্ত মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাচ্ছি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রঘুনাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বাংলানিউজকে বলেন, বিদ্যালয়ে আমরা তো আসছি, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা করাচ্ছি। কিন্তু আমাদের এক সিনিয়র শিক্ষক নানা অজুহাত দেখিয়ে বিদ্যালয়ে আসেন না। তার পরিবর্তে স্থানীয় একটি ছেলেকে তিন হাজার টাকা বেতন দিয়ে প্যারা শিক্ষক হিসেবে রাখা হয়েছে।

শিবালয় উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো. সিরাজুল ইসলাম বিশ্বাস বাংলানিউজকে বলেন, শিক্ষক তো কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়োগ হয়, যার কারণে আমাদের কিছুই করার নেই। তবে বদলি প্রক্রিয়া আমাদের হাতে। প্রতি জুন-জুলাইয়ে বদলি প্রক্রিয়া কার্যক্রম শুরু হয়। আমি কিছুদিন হয় এ উপজেলায় যোগদান করেছি, যে কারণে বদলির তদবিরের বিষয়টি আমার জানা নেই। আমার অধীনে পাঁচটি স্কুল আছে। দুর্গম চরাঞ্চলের ওই স্কুলগুলো যাতায়াতের এক মাত্র মাধ্যম হলো নৌকা। চরাঞ্চলে দিনে একবার নৌকা যায়, যার কারণে হয়তো শিক্ষকরা স্কুল ছুটির আগেই চলে যান। তবে এটি করতে পারেন না। যদি এ ধরনের কাজ কোনো শিক্ষক করে থাকেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ নেওয়া হবে। কোনো শিক্ষক বিদ্যালয়ে না গিয়ে তার পরিবর্তে প্যারা শিক্ষক দিয়ে পাঠদান করাবে এটা মেনে নেওয়ার মতো বিষয় না। বিষয়টি আমি দেখে দ্রুত সময়ের ভেতর ব্যবস্থা নেবো।

বাংলাদেশ সময়: ১৩২৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৯
আরবি/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।