জানা গেছে, বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ, সৈয়দ হাতেম আলী সরকারি কলেজ, বরিশাল শেরে-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ, সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটসহ অন্য কলেজগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের থাকার জন্য ২০টি মতো হোস্টেল রয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ হোস্টেলই পুরনো হওয়ায় জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা জানান, এই কলেজে হোস্টেলের ভেতর রুম দখল করে শিক্ষার্থী নির্যাতন বা মারধরের ঘটনা না ঘটলেও রাজনৈতিক দলের বড় ভাইদের কারণে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে অনেকেই। তবে, বেশ কিছুদিন এ সমস্যাটি না থাকলেও কলেজের ছাত্রাবাসগুলোতে নিয়মিতই বসছে মাদকের আড্ডা। বিশেষ করে, ডিগ্রি হলখ্যাত অশ্বিনী কুমার হলটি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতাদের দখলে রয়েছে। এই হলের কমপক্ষে ছয়টি রুমে সন্ধ্যার পরপরই বসে মাদকের আসর। শুধু তাই নয়, এ হলে ছাত্রনেতারা তাদের হাতিয়ারও সংরক্ষণে রাখেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া, বিএম কলেজের হিন্দু হলখ্যাত জীবনানন্দ দাশ হলের প্রায় সাতটি রুমে বসে মাদকের আসর। এ আসরে শুধু কলেজের সিনিয়রেরাই নয়, সাবেক ছাত্র ও বহিরাগতরাও বসছেন নিয়মিত। সহজে আসা-যাওয়ার বেশ কিছু পথ থাকায় এ ক্যাম্পাসে মাদক বিক্রি হচ্ছে হরহামেশা।
হোস্টেলের শিক্ষার্থীরা জানান, সন্ধ্যার পর কলেজ ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের মোটরসাইকেলের আনাগোনাই জানান দেয় এরা কতটা ঐক্যবদ্ধ। রাজনৈতিক প্রভাবসহ নানা ভয়ে কেউ এর প্রতিবাদ করতে চায় না। আর হোস্টেলগুলোতে কাগজে-কলমে সুপারের পদে কোনো না কোনো শিক্ষক থাকলেও তারা কেউই আসেন না। ফলে, হলগুলোতে ইচ্ছেমতো চলাফেরা করে ছাত্ররা। কেউ মধ্যরাতে হলে আসলেও কারও কিছু যায়-আসে না।
কলেজের বনমালী গাঙ্গুলী ছাত্রী হোস্টেলে বাকি সব ঠিকঠাক থাকলেও রয়েছে অবৈধ রুম দখলের অভিযোগ। শিক্ষার্থীদের দাবি, সাদিয়া আক্তার সাবিহা নামে এক শিক্ষার্থী প্রায় দুই বছর আগে পড়াশোনা শেষ করলেও তিনি এক নম্বর বিল্ডিংয়ের ২০৮ নম্বর রুম এখনো দখলে রেখেছেন। হোস্টেলে তার কাছের লোকজনও বেশ ক্ষমতাধর। তবে, হোস্টেলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতের জন্য বর্তমানে মল্লিকা নামে কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষক নিয়মিত থাকছেন।
অপরদিকে, বরিশাল শেরে-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রাবাসগুলোতে দুই বছর আগ পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও এখন সেটি বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন আবাসিক শিক্ষার্থীরা। তবে, এ কলেজের এক নম্বর হোস্টেলখ্যাত হাবিবুর রহমান ছাত্রাবাসের দ্বিতীয় তলার বেশ কয়েকটি রুমে সন্ধ্যার পরে মাদকের আসর বসার অভিযোগ রয়েছে। আর হাবিবুর রহমান, জামিলুর রহমান ও মঈনুল হায়দার নামে ছাত্রদের তিনটি হোস্টেলেই বহিরাগতদের আনাগোনা থাকে সবসময়। গোটা ক্যাম্পাসজুড়ে বহিরাগতদের বেশ কয়েকটি গ্রুপ বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। তারা মাদক সেবনের পাশাপাশি ছিনতাইয়ের মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছে অহরহ।
এছাড়া, শেবাচিম হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকদের এফ এম নূর উর রফী হোস্টেলেও নিয়মিত মাদকের আসর বসে বলে জানা গেছে। সবশেষ ১৭ অক্টোবর এ হোস্টেলের তৃতীয় তলার ৩০৩ নম্বর রুম থেকে রিফাতুল ইসলাম রন্টি নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে ৫২০ পিস ইয়াবাসহ আটক করা হয়। এছাড়া, হোস্টেলের দ্বিতীয় তলার ২০৯, ২১২, চতুর্থ তলার ৪০৪সহ অন্তত আটটি রুম বহিরাগত বা সাবেক ছাত্রনেতাদের দখলে রয়েছে। মেডিক্যাল কলেজের মেয়েদেরসহ কোনো হোস্টেলেই সুপার বা আবাসিক শিক্ষকেরা থাকেন না বিধায় সব শিক্ষার্থী স্বাধীনভাবেই জীবনযাপন করছেন।
বরিশাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি, বরিশাল সরকারি পলিটেকনিক ও সৈয়দ সরকারি হাতেম আলী কলেজসহ বেশ কিছু সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবাসিক হোস্টেল রয়েছে। সেসব হোস্টেলে শিক্ষার্থীদের দেখভালের জন্য হল সুপার কাগজে-কলমে নিয়োগ দেওয়া থাকলেও তাদের কেউই ক্যাম্পাসে থাকেন না। আর এসব কলেজের হোস্টেলগুলোতে প্রতিনিয়ত বহিরাগতদের আনাগোনা, মাদক সেবনসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার, অভিভাবকহীন অবস্থায় হোস্টেলগুলোতে স্বাধীন জীবনযাপনের সুযোগ পাওয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীরাও এর প্রতিবাদ করেন না।
তবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হল সুপারেরা বলছেন, হলগুলোতে ছেলেরা এমনভাবে চলাফেরা বা বসবাস করে, একজন শিক্ষক হয়ে তাদের সঙ্গে সম্মান বজায় রেখে থাকাটা কষ্টকর। সেদিক থেকে হোস্টেলের পাশে আলাদা আবাসন ব্যবস্থা থাকলে সুবিধা হতো। কিন্তু, কোনো ক্যাম্পাসেই তা নেই। আর ছাত্রী হোস্টেলে পুরুষ সুপার নিয়োগ নিয়েও রয়েছে মতবিরোধ। আবার, যদি নারী সুপার দেওয়াও হয়, তিনি মনের মতো না হলে মানতে চান না ছাত্রীনেতারা।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের প্রভোস্ট রাহাত হোসেন ফয়সাল বাংলানিউজকে বলেন, এই হলে যে মাদক সেবন হয়, সেধরনের কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হলে ‘কমপ্লেইন বক্স’ রয়েছে। সেখানে বেনামেও অভিযোগ দেওয়া যায়। অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
বরিশাল সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মু. মোস্তফা কামাল বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের হোস্টেলে বহিরাগতদের বসবাস নেই। তবে, তাদের উৎপাত আছে কিছুটা। এ বিষয়ে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রয়েছে।
বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক শফিকুর রহমান সিকদার বাংলানিউজকে বলেন, আমরা হোস্টেলগুলোকে ঢেলে সাজাতে চাই। চাই সুস্থ ও পরিচ্ছন্ন ব্যবস্থা, যা নিয়ে কাজও শুরু করেছি। তবে, এবার প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কারণে সবাই যেভাবে এগিয়ে এসেছে, সেভাবে সবাইকে সবসময়ই আসা উচিত। কিছু কিছু কাজ কারও একার পক্ষে করা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, হল সুপারদের ডাকা হয়েছে, তাদের কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছে- কোন রুমে কী সমস্যা হচ্ছে। বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সে যে দলেরই হোক না কেন, ক্যাম্পাসের পরিবেশ নষ্ট করতে দেওয়া হবে না।
এছাড়া, বরিশালের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাস বা হলগুলোতে পুলিশের বিশেষ নজরদারি রয়েছে বলে জানিয়েছেন মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন ভূঞা।
বাংলাদেশ সময়: ০০০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৯
এমএস/একে