ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

জবির নতুন ক্যাম্পাস প্রকল্পে ৫৪১ কোটি টাকার গড়মিল!

মহিউদ্দিন রিফাত, জবি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২১ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০২১
জবির নতুন ক্যাম্পাস প্রকল্পে ৫৪১ কোটি টাকার গড়মিল!

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি): ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কারাগারের জমিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল নির্মাণের দাবিতে আন্দোলন করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের আন্দোলনের কারণে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের কার্যনির্বাহী পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য কেরানীগঞ্জে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের ঘোষণা দেন।

এরপর ২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের কার্যনির্বাহী পরিষদের সভায় কেরানীগঞ্জে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের পর বর্তমান ক্যাম্পাসের সমূদয় সম্পত্তি সরকারের কাছে হস্তান্তরের বিনিময়ে নতুন ক্যাম্পাসের কাজ শুরু হয়।

এ সময় ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপন: ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত একটি প্রকল্প অনুমোদন হয়। যেখানে বাজেট ধরা হয় ১ হাজার ৯২০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।

এ প্রকল্পের মাধ্যমে ভূমি অধিগ্রহণ, ভূমি উন্নয়ন, পরিকল্পনা ও প্রকৌশল ভবন নির্মাণ, সীমানা প্রাচীর, অভ্যন্তরীণ রাস্তা নির্মাণ, লেক খনন, পুকুর খনন, ঘাট নির্মাণ, সংযোগ সেতু নির্মাণ, অভ্যন্তরীণ সারফেস ড্রেন নির্মাণ ও মাস্টারপ্ল্যানের কাজ করতে হবে। কিন্তু নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের ঘোষণার পাঁচ বছরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ১৮৮ দশমিক ৪ একর জায়গা অধিগ্রহণ করেছে। এছাড়া ২০০ একরের ক্যাম্পাসের এখনও ১১ দশমিক ৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা বাকি। মন্ত্রণালয়ে ফাইল চালাচালি, নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের মাস্টারপ্ল্যানের কাজ নির্দিষ্ট কোম্পানিকে দেওয়ার পায়তারায় অনিয়ম ও করোনাকালীন সংকটে জমি অধিগ্রহণ ছাড়া আর কোনো কাজই হয়নি।

এদিকে প্রকল্পের মেয়াদ তিন দফায় ২০২৩ সালে জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ প্রকল্পে ২০১৯ সালে ৮৯৯ কোটি ৮০ লাখ ৪৯ হাজার টাকা ব্যয়ে ১৮৮ দশমিক ৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত ১৪৪১ কোটি ৪ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। প্রকল্পের ব্যয়ে ১ হাজার ৪৪১ কোটি টাকার মধ্যে ৫৪১ কোটি টাকা কোন কোন খাতে ব্যয় হয়েছে তা তিন মাস আগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তথ্য অধিকার আইনে চাওয়া হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সে হিসাব দিতে পারেনি।

প্রকল্পের অর্থ কোন কোন খাতে ১ হাজার ৪৪১ কোটি ৪ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী সাহাদাত হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, এত টাকা ব্যয় হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ব্যয়ের তথ্য ভুয়া।

সঠিক তথ্য কোনটি জানতে চাইলে তার কোনো উত্তর না দিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যান তিনি।

জানা যায়, ২০১৯ সালে ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপন: ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের জন্য ২৯ কোটি ৫৮ লাখ ৯৮ হাজার টাকার ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। প্রকল্পের অনুমোদিত ডিপিপিতে জিওবির অর্থায়নে মাস্টারপ্ল্যান এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠান খাতে ৩০ কোটি টাকা রাখা হয়। ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বিজ্ঞপ্তির পর ২১ মার্চ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের জন্য ১৮টি প্রতিষ্ঠানের ইওআই গ্রহণ করে। ৩০ নভেম্বর প্রস্তাব মূল্যায়ন কমিটি ১৮টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত তালিকা করে। ২০২০ সালের ১৫ মার্চ তিনটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আরএফপি এর চাহিদা অনুযায়ী টেকনিক্যাল ও ফিনান্সিয়াল প্রস্তাব দাখিল করে। এ তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সৃজনী উপদেষ্টা লিমিটেডের কারিগরি মূল্যায়নে সর্ব্বোচ্চ স্কোর অর্জন করে এবং তাদের সেবার মূল্য ৪ কোটি ৮ লাখ ৫১ হাজার টাকা। কিন্তু ২০২০ সালের ১২ অক্টোবরে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমানের পরামর্শে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান আরবানাকে ২১ কোটি ৬০ লাখ টাকা নির্ধারণ করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসাবে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় আরেকটি প্রতিষ্ঠান ডিপ্লোপমেন্ট ডিজাইন কনসালটেন্স লিমিটেড ১৭ কোটি ৫০ লাখ টাকায় সেবার মূল্য নির্ধারণ করে।

কিন্তু গত ১১ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০২০-২১ আর্থিক বার্ষিক কর্মসূচির সভায় ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপন: ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগ ও মাস্টারপ্ল্যানের জন্য ক্রয় প্রক্রিয়া পিপিআর অনুযায়ী না হওয়ায় বিষয়টি মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন দেয়নি। মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য অনুরোধ করলে পিপিআর এর ব্যত্যয় উল্লেখ করেন। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি কম্পোনেটের ইআইও আহ্বান করেন।

বিষয়টি বিব্রতকর উল্লেখ করে সভায় ভবিষ্যতে এ ধরণের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার জন্য এবং পিপিআর অনুযায়ী ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য সবাইকে অনুরোধ করেন। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আবারও আরবানা কোম্পানিকে সিঙ্গেল চয়েজের ভিত্তিতে মাস্টারপ্ল্যানের কাজ দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করে।

২০২১ সালের ৩ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইমদাদুল হক যোগদানের পর মাস্টারপ্ল্যানের কোম্পানি নিয়োগে জটিলতা ও অনিয়মের কারণে পুরো প্রক্রিয়া বাতিল করেন। গত ২৩ আগস্ট মাস্টারপ্ল্যানের জন্য পুনরায় দরপত্র আহ্বানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, ২০১৯ সালে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি মাস্টারপ্ল্যানের চিত্র উপস্থাপন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ মাস্টারপ্ল্যানের চিত্র বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শনও করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যালেন্ডারেও এর একটি ডিজাইন প্রকাশ করা হয়। এ মাস্টারপ্ল্যানটির ডিজাইন প্রতিষ্ঠান নিয়োগের আগেই আরবানা প্রতিষ্ঠান থেকে করে নেওয়া হয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পন,উন্নয়ন ও ওয়ার্কস দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান।

বিশ্ববিদ্যালয় ইঞ্জিনিয়ার প্রকৌশলী হেলালউদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, নতুন ক্যাম্পাসের সীমানা প্রাচীরের দরপত্র অনুমোদনের অপেক্ষায়। দ্রুতই সীমানা প্রাচীরের কাজ শুরু হবে। লেক নির্মাণের দরপত্র জমা হয়েছে। আর মাস্টারপ্ল্যানের জন্য পুনরায় দরপত্র দুই একদিনের মধ্যে দেওয়া হবে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার প্রকৌশলী ওহিদুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি মাস্টারপ্ল্যান উপস্থাপন করা হয়েছে বলে শুনেছি। তবে এ সভায় কারা উপস্থিত ছিলেন আর কাদের তৈরি করা ডিজাইনটি ছিল সে বিষয়ে আমি কিছু জানতে পারিনি।

নতুন ক্যাম্পাসের কাজের অগ্রগতি ও পরিকল্পনা সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইমদাদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, নতুন ক্যাম্পাসের কাজের মাস্টারপ্ল্যানের দরপত্রে জটিলতা ছিল। আগের পুরো প্রক্রিয়া বাতিল করে নতুন করে দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া চলছে। কাজ দ্রুত করার জন্য ইউজিসি, মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একাধিক বৈঠক করেছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৭১৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০২১
কেএআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।