ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

এসটিএস গ্রুপের শিক্ষা বাণিজ্য

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০২১
এসটিএস গ্রুপের শিক্ষা বাণিজ্য

ঢাকা: শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করতে গিয়ে ২০১৭ সাল থেকে একের পর এক সমালোচনার মুখে পড়ছে এসটিএস গ্রুপের এডুকো বাংলাদেশ লিমিটেড। আদালত অবমাননার অভিযোগে হাইকোর্টে তলব, করোনাকালে টিউশন ফি নিশ্চিত করতে অভিভাবকদের ঋণ নিতে বাধ্য করাসহ নানা অভিযোগে জর্জরিত প্রতিষ্ঠানটি।

সম্প্রতি বিদেশি স্টাডি সেন্টার খুলে আবারও শিক্ষা নিয়ে বেআইনি উদ্যোগ নেওয়ায় সমালোচনার জন্ম দিয়েছে এসটিএস গ্রুপ। ইউজিসি বলছে—স্টাডি সেন্টারের এ ধরনের কর্মকাণ্ড চলানোর কোনো এখতিয়ার নেই। দ্রুত বন্ধ করে সরকারের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

আদালত অবমাননার অভিযোগে হাইকোর্টে তলব
২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত দিল্লি পাবলিক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে (ডিপিএস-এসটিএস) ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চা করায় স্কুলটির প্রধান শিক্ষক হার্শা ওয়ালকে তলব করেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টে হাজির হয়ে তাকে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়। ১২ ডিসেম্বর এক আবেদনের প্রেক্ষিতে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. মাহমুদ হাসান তালুকদারের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

ব্যারিস্টার অনিক আর হক বলেন, ‘ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে বাংলা ভাষা ও দেশীয় সংস্কৃতি চর্চার জন্য হাইকোর্টের রায়ে নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু সেই সব নির্দেশনা অমান্য করে উত্তরায় অবস্থিত দিল্লি পাবলিক স্কুলে ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চা ও ভারতীয় বিভিন্ন দিবস, ব্যক্তি সম্পর্কে পড়ানো হচ্ছে। এছাড়া স্কুলটির অষ্টম শ্রেণির একটি বইয়ে অশ্লীল শব্দমালা রয়েছে, যা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পড়ানো হচ্ছে। ফলে শফিউল আযমসহ ১৫ জন অভিভাবকের পক্ষে ১৩ নভেম্বর স্কুলের অধ্যক্ষকে আদালত অবমাননার নোটিশ দেওয়া হয়। নোটিশের জবাব না পেয়ে আদালত অবমাননার মামলা করি। আদালত ডিপিএস-এসটিএস ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের অধ্যক্ষকে তলবসহ আদালত অবমনানার রুল জারি করেন।

টিউশন ফি পরিশোধে বাড়তি চাপ
২০২০ সালে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি পরিশোধে অভিভাবকদের ঋণ নিতে বলে রাজধানীর ডিপিএস এসটিএস (দিল্লি পাবলিক) স্কুল কর্তৃপক্ষ। ডিপিএস এসটিএস স্কুলের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষকরা অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন। তারা শিক্ষায় অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা বজায় রাখছেন। বর্তমানে স্কুলের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি আদায় করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। ’

এতে আরও বলা হয়, ‘বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে অনেক অভিভাবক আর্থিক সংকটে রয়েছেন। এজন্য স্কুলের পক্ষ থেকে মাইডাস ফাইন্যাসিং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে অভিভাবকদের লোনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অভিভাবকরা চাইলে এ প্রতিষ্ঠান থেকে লোন নিয়ে তার সন্তানের মাসিক টিউশন ফি পরিশোধ করতে পারবেন। ’

বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ অভিভাবক ফোরামের পক্ষ থেকে জানানো হয়, স্কুল বন্ধ থাকায় গত এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত ৫০ শতাংশ টিউশন ফি মওকুফের জন্য অভিভাবক ফোরামের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে অনুরোধ জানালেও তা কার্যকর হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় অভিভাবকদের কাছে টিউশন ফি আদায় ও চাপ প্রয়োগ না করতে সরকারিভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অথচ এ সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে স্কুল কর্তৃপক্ষ টিউশন ফি আদায়ে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করছে। এতে অনেকে অপারগতা স্বীকার করলে বর্তমানে সুদে লোন নিয়ে টিউশন ফি দিতে বলা হচ্ছে।

এবার মোনাশ কলেজ বাণিজ্য
সর্বশেষ এসটিএস গ্রুপের এডুকো বাংলাদেশ লিমিটেড মোনাশ কলেজের নামে একটি স্টাডি সেন্টারের মাধ্যমে শিক্ষা বাণিজ্য শুরু করেছে। ইউনিভার্সাল কলেজ বাংলাদেশ (ইউসিবি) নামের স্টাডি সেন্টারের বিপরীতে একাডেমিক কার্যক্রমের অনুমতি না নিয়েই ইতোমধ্যে অবৈধভাবে ৪২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়েছে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তিন বছরের কোর্সের জন্য টিউশন ফি বাবদ ৪০ লাখ টাকা নেওয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।



সূত্রমতে, এক বছর লেখাপড়া করিয়ে ক্রেডিট ট্রান্সফারের মাধ্যমে মোনাশ কলেজের অস্ট্রেলিয়া ও মালেশিয়ায় ভর্তির প্রলোভন দেখানো হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। মোনাশ ইউনিভার্সিটি অস্ট্রেলিয়া বা মালয়েশিয়ায় সরাসরি দ্বিতীয় বর্ষে লেখাপড়ার সুযোগ করে দেওয়ারও অফার দিয়েছে। এক বছর লেখাপড়ার পর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলেও দেশে বা বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির হওয়ার সুযোগ দেওয়া প্রতিশ্রতি দিচ্ছে তারা।

সিদ্ধান্ত বাতিল চেয়ে ইউজিসিকে আইনি নোটিশ
নিয়ম বহির্ভূতভাবে বাংলাদেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের ক্যাম্পাস স্থাপনের সিদ্ধান্ত বাতিল চেয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যানকে একটি আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। গত সোমবার (২২ নভেম্বর) নোটিশ প্রেরণের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ব্যারিস্টার অনিক আর হক। তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মনজুর নাহিদের পক্ষে এ নোটিশ পাঠানো হয়েছে।

নোটিশে বলা হয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ এর ৩৯ ধারায় বলা আছে, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাংলাদেশে ক্যাম্পাস স্থাপন বা কার্যক্রম পরিচালনা করতে করতে চাইলে তাদের দেশে অনার্স, মাস্টার্স, ডিপ্লোমা বা সার্টিফিকেট কোর্স পরিচালনা করতে হবে। কিন্তু আইনে স্পষ্টভাবে বলা সত্ত্বেও গত ২৫ ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ কলেজকে বাংলাদেশে স্টাডি সেন্টার স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যে স্ট্যাডি সেন্টারের সার্টিফিকেট শুধু এই কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। অথচ দেশে বর্তমানে ১০৮ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়োও তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এমতাবস্থায় দেশে মোনাশ কলেজের স্টাডি সেন্টার স্থাপন অবৈধ ও আইন বহির্ভূত।

শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের কর্মকাণ্ড অনৈতিক। শুধু বাণিজের জন্য শিক্ষার্থীদের লোভনীয় অফার দিচ্ছে, যা দেশের উচ্চশিক্ষাকে হেও প্রতিপন্ন করে। দেশের পুরো উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা অলাভজনক হলেও শিক্ষা নিয়ে এ ধরনের বাণিজ্য শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষতি করবে।

এ বিষয়ে ইউজিসি বলছে, স্টাডি সেন্টারের এ ধরনের কর্মকাণ্ড চলানোর কোনো এখতিয়ার নেই। দ্রুত বন্ধ করে সরকারের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর বলেন, সার্বিকভাবে বিষয়টি নিয়ে ইউজিসি বিব্রত। ২০১৪ সালের বিধিমালাটি চূড়ান্ত হওয়ার আগে স্টাডি সেন্টার সংক্রান্ত কার্যক্রম চালাতে প্রকৃতপক্ষে আগ্রহী না ইউজিসি। বর্তমানে মন্ত্রণালয় একটি স্টাডি সেন্টার খোলার অনুমতি দিয়েছে ঠিকই কিন্তু এর একাডেমিক কার্যক্রম খোলার অনুমতি বিদ্যমান বিধিমালা অনুযায়ী কেবল ইউজিসি দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে ইউজিসি তাদের একাডেমিক কার্যক্রম চালানোর কোনো অনুমতি দেয়নি। তারা যদি শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে থাকে, সেটা ইউজিসির অজ্ঞাতে হচ্ছে। ইউজিসি এর দায়ভার নেবে না। এক অর্থে বলা যায়, এই কর্মকাণ্ড অবৈধ।

আরও পড়ুন: স্টাডি সেন্টারের আড়ালে ক্যাম্পাস, টিউশন ফি ৪০ লাখ!

বাংলাদেশ সময়: ২০২৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০২১
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।