ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

২০০ শিক্ষক-কর্মচারীর এক মাসের বেতন ‘অডিট কর্মকর্তার’ পকেটে!

উত্তম ঘোষ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০২২
২০০ শিক্ষক-কর্মচারীর এক মাসের বেতন ‘অডিট কর্মকর্তার’ পকেটে! শিক্ষা পরিদর্শক ড. এনামুল হক

ঢাকা: শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) শিক্ষা পরিদর্শক ড. এনামুল হকের বিরুদ্ধে ‘মিনিস্ট্রি অডিটের’ নামে শিক্ষক-কর্মচারীদের পুরো একমাসের বেতনের অর্ধকোটি টাকা ঘুষ হিসেবে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। চাকরি চলাকালে বিপদে পড়া অথবা অবসরে গেলে পেনশনের টাকা নিয়ে ঝামেলার ভয়ে এক মাসের বেতনের পুরো টাকা ঘুষ হিসেবে দিতে বাধ্য হয়েছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা!

শুধু যশোরের মণিরামপুর উপজেলার ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্তত ২০০ শিক্ষক-কমচারীর মূল বেতন স্কেলের পুরো টাকা ঘুষ হিসেবে নিয়েছেন ওই কর্মকর্তা।

সূত্রমতে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের তদন্ত বহু আগে থেকেই মফস্বলের শিক্ষক সমাজের কাছে ‘মিনিস্ট্রি অডিট’ নামে পরিচিত। যদিও ‘ডিআইএ’ নামে এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা দাবি করে থাকেন, অডিট এবং তদন্ত ভিন্ন। কিন্তু নিজেরা যখন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যান তখন নিজেদের ‘মিনিস্ট্রি কর্মকর্তা’ এবং ‘অডিট করতে এসেছেন’ এই দুই শব্দ ব্যবহার করে শিক্ষক-কর্মচারীদের জিম্মি করে ফেলেন।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, মার্চ মাসের শুরুতে যশোরের মণিরামপুর পৌর শহরের মণিরামপুর মহিলা আলিম মাদ্রাসা, হাজরাকাঠি মহিলা আলিম মাদ্রাসা, ডুমুরখালি দাখিল মাদ্রাসা, মনোহরপুর দাখিল মাদ্রাসা, বালিধা-পাঁচাকড়ি দাখিল মাদ্রাসা, রোহিতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, হাজীআলী নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দেলুয়াবাড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে অডিট করবে জানিয়ে চিঠি দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর।

যশোর জেলা ও মণিরামপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারকে পাঠানো চিঠিতে, অডিটে নিযুক্ত কর্মকর্তাকে সহযোগিতার অনুরোধ জানানো হয়। পরে অধিদপ্তরের পরিদর্শক পদমর্যদার কর্মকর্তা ড. এনামুল হক যশোরে এসে একটি রেস্ট হাউজে ওঠেন এবং শিক্ষা অফিসের কর্মচারীদের মাধ্যমে ওই ১০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানকে রেস্ট হাউজে দেখা করতে বলেন। এরপর কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ড. এনামুল হকের সঙ্গে দেখা করে অডিটের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টরা বলেন, ‘তিনি একজন আজব অডিট কর্মকর্তা এবং আজব অডিট করে গেলেন’। কারণ হিসেবে বলেন, ‘ওই রেস্ট হাউসে দেখা করলে তিনি প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের কাছে সরাসরি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম ধরে বলেন, আপনাদের অনেক ফাঁক-ফোকর! প্রকৃত অডিট হলে পুরাতন-নতুন বহু শিক্ষকের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জটিলতা ধরা পড়বে। এতে তার বেতন বন্ধ হবে, অবসরে গেলে পেনশন পেতে দুর্ভোগ হবে আবার ক্ষেত্রবিশেষ বহু শিক্ষকের চাকরিও যাবে। ফলে, আপনারা ঝামেলা না চাইলে, আমিও ঝামেলা করতে চাই না। আপনারা কোন পথে যাবেন, নিজেরা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ঠিক করেন। ’

অডিটরের কথা মতো এবং পুরাতন রেওয়াজ অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা স্ব স্ব বিদ্যালয়ে ফিরে কথাগুলো শিক্ষক-কর্মচারীদের জানিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এটা নতুন কিছু না, প্রতি ১০ বছর অন্তর ‘মিনিস্ট্রি অডিট’ হয়। ফলে আমাদের বাড়াবাড়ি না করে এ মাসের বেতন তাকে ঘুষ হিসেবে দিয়ে ঝামেলামুক্ত হওয়া ভালো। ’

এরপর প্রতিষ্ঠানপ্রধানের কথায় ইচ্ছা না থাকলেও ঝামেলার ভয়ে বেতনের টাকা ঘুষ হিসেবে দিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব মেনে নেন সবাই। পরদিনই জেলার ওই ১০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অডিট শুরু করেন ড. এনামুল হক। কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গভীর রাতেও চলে অডিট। শিক্ষকদের ভাষায়, ‘মিনিস্ট্রি অডিটের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ড. এনামুলের প্রতিষ্ঠানে আগমন উপলক্ষে তাকে খুশি করতে পূর্ব মতামতের ভিত্তিতে আয়োজন করা হয় ভুরিভোজের। প্রথমে নাস্তায় অন্তত ১০ রকম ফল ও মিষ্টির আয়োজন থাকে। পরে গল্প-গুজবের মধ্য দিয়ে অডিট সম্পন্ন শেষ হলে, খানাপিনায় ছিটা রুটি, দেশি মুরগির মাংস, সাদা ভাত, পোলাও চাউলের ভাত, দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির বিলের মাছ, খাসির মাংস ও বিভিন্ন স্বাদের মিষ্টি ও কোমল পানীয়ের বিরাট আয়োজন চলে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে।

ভুক্তভোগীরা আরও জানান, অডিটে গিয়ে ড. এনামুল হক শিক্ষকদের সান্ত্বনা দেওয়ার সুরে বলেন, ‘আসলে এতে আমার কিছুই করার থাকে না। এই টাকার ভাগ সবাইকে দেওয়া লাগে!’ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বড় পদের নাম উল্লেখ করে বলা ছাড়াও বর্তমান সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতার নাম ধরেও বলেন, ‘ওমুক ভাইকেও টাকা দেওয়া লাগে! তা না হলে আমার চেয়ার কি থাকবে? একটানা এতবছর এই বিভাগে এই কাজে আছি, চেয়ার কি নড়ছে? নড়বেও না!’

আজব অডিট শেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েকজনের সাথে শলাপরামর্শ করে জানিয়ে দেন, নগদ টাকা তিনি নিয়ে যেতে পারবেন না। ফলে আলাদা-আলাদা সময় অনুযায়ী স্ব স্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত কয়েকজন শিক্ষক-কর্মচারী মিলে সকল শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে এক মাসের বেতনের টাকা আদায় করে ‘টাকার ব্যাগ’ নিয়ে ঢাকায় যান। এরপর ওই কর্মকর্তাকে ফোন করে সাক্ষাতের স্থানের ঠিকানা নিয়ে রাজধানীর একটি বাসায় (ঠিকানা সংরক্ষিত) ঘুষের টাকা পৌঁছে দেন।

বিষয়টি কঠোর গোপনীয়তার নির্দেশ থাকলেও কষ্টার্জিত বেতনের পুরো টাকা ঘুষ দিয়ে মনোকষ্টে শিক্ষকরা বিষয়টি নিজেদের মধ্যে কানাঘুষো শুরু করেন, যা আস্তে-আস্তে আশপাশের শিক্ষকদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মণিরামপুর মহিলা আলিম মাদ্রাসার একজন শিক্ষক এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘শুধু আমি কেন, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার অধিকাংশ শিক্ষকদের নির্ধারিত বেতন তুলে হাতেগোনা টাকা দিয়েই সংসার চালাতে হয়। আর দশটা চাকরির মতো এখানে ঘুষ-দুর্নীতি কিংবা বকশিশের মতো উপরি আয়ের সুযোগ নেই। ফলে মাসের বেতনের টাকায় গোটা সংসার পরিচালনা করে নিয়মতান্ত্রিক জীবনে চলতে অভ্যস্ত আমরা। অধিকাংশ শিক্ষকের ক্ষেত্রে নুন আনতে পানতা ফুরানোর অবস্থা হলেও আত্মমর্যাদার কারণে ঘরের অভাব কাউকে জানাতেও পারি না। অনেক হিসাব করে সংসার চালাতে হয়। এই টাকাতেই তো সবকিছু। এক মাসের বেতন জোর করে ঘুষ নিয়ে বিপদে ফেলে দিলো আমাদের। ’

ভুক্তভোগী আরেক শিক্ষক বলেন, ‘আমি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাড়ি করেছি, প্রতিমাসের বেতন পেয়ে কিস্তি দেই। এ মাসে বেতন না পেয়ে ব্যাংকের লোকদের কাছে অসম্মানের ভয়ে স্ত্রীর গহনা বন্দক রাখতে বাধ্য হয়েছি। ছেলের পড়ার খরচ পাঠালাম ধার-দেনা করে। ’

মণিরামপুরের রোহিতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভুক্তভোগী একাধিক শিক্ষক বলেন, ‘আমাদের প্রধান শিক্ষক অশোক কর্মকার এসব ব্যাপারে খুবই ভীতু মানুষ। তার কথামতো সব শিক্ষক-কর্মচারী পুরো একমাসের বেতন দিতে বাধ্য হয়েছি। ’

মণিরামপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বিকাশ চন্দ্র সরকার বাংলানিউজকে বলেন, ‘চিঠির মাধ্যমে আমরা শুধু জেনেছি ডিআইএ কর্মকর্তা এসে তদন্ত করবেন। পরে আমি কিছুই জানি না। ’

ঘুষ বাণিজ্য সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে ওনারা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, এ বিষয়ে কোনো ধরনের মতামত দেওয়া আমার জন্য সমাচীন নয়’।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) পরিদর্শক ড. এনামুল হক বাংলানিউজকে বলেন, ‘ঘুষ বাণিজ্যের বিষয়টি সঠিক নয়। তবে আমার নাম ভাঙিয়ে যদি প্রতিষ্ঠানপ্রধানরা এমন কিছু করেন এতে আমার কিছু করার নেই।

দকে রাত্রিকালীন অডিটে ভুরিভোজ ও ঘুষের টাকা ঢাকায় পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করলেও সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি তিনি।

যশোর জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এ কে এম গোলাম আযম বাংলানিউজকে বলেন, ‘ডিআইএ থেকে তদন্ত করে গেছে জানি। বিষয়টি আমাদের কার্যক্রমের মধ্যে পড়ে না বলে খোঁজ-খবর রাখা হয়নি। এমনকি ঘুষ বাণিজ্য নিয়ে কেউ অভিযোগও করেননি। ’

তিনি আরও বলেন, ‘কোনো শিক্ষক গোপনেও অভিযোগ করলে প্রয়োজনে বিষয়টি আমি মহাপরিচালক স্যারকে জানাবো। ’

শিক্ষকদের উদ্দেশে এই শিক্ষা অফিসার বলেন, ‘কাউকে ভয় করার দরকার নেই। সরাসরি অভিযোগ দেন। ’

এ বিষয়ে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) পরিচালক প্রফেসর অলিউল্লাহ্ মো. আজমতগীর বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমি সবসময় বলে থাকি আমার অফিসের কেউ কোনো দুর্নীতি-অনিয়ম করলে সরাসরি অভিযোগ করেন। এমনকি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সরাসরি সরকারের কেন্দ্রীয় অভিযোগ বক্সে অভিযোগ দেন। তবে যশোরের এ বিষয়ে আমার কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি। ’

বাংলাদেশ সময়: ২২০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০২২
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।