ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিনোদন

এক কিংবদন্তি নির্মাতার গল্প

বিনোদন ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০২৩
এক কিংবদন্তি নির্মাতার গল্প

ঢাকা: বাংলা সাহিত্যের বরপুত্র, শব্দের জাদুকর হুমায়ূন আহমেদের ৭৫তম জন্মদিন আজ। রসবোধের সঙ্গে লৌকিকতা আর অলৌকিকতার সমগ্র সুন্দরের মিশেলে বাংলা কথাসাহিত্যকে যিনি সমৃদ্ধ করেছেন, সেই কিংবদন্তির জন্মদিন আজ।

১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন বিংশ শতাব্দীর বাঙালি জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। তাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী শ্রেষ্ঠ লেখক গণ্য করা হয়। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার ও গীতিকার। বলা হয় আধুনিক বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের তিনি পথিকৃৎ। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই শতাধিক। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি সংলাপপ্রধান নতুন শৈলীর জনক।

শুধু সাহিত্যেই নয়, ক্যামেরার জগতেও তিনি অনন্য এক প্রতিভাবান মানুষ ছিলেন। তার কালজয়ী বহু সৃষ্টি আজও চিরসবুজ। অমর হয়ে আছে কোটি দর্শকের হৃদয়ে। সাহিত্য অঙ্গনের মতোই বাংলা নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও ছিলেন হুমায়ূন সমাদৃত।

তার নির্মিত চলচ্চিত্রসমূহ পেয়েছে অসামান্য দর্শকপ্রিয়তা। তার হাতের ছোঁয়ায় বদলে গিয়েছিল বাংলার চলচ্চিত্র অঙ্গন। তার নির্মিত টেলিভিশন নাটকগুলো ছিল সর্বাধিক জনপ্রিয়। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর বাংলা নাট্য জগতের সেই ঐতিহ্য আর ফিরে আসেনি। গীতিকার হিসেবেও তিনি ছিলেন অনন্য।

সংখ্যায় বেশি না হলেও তার রচিত গানগুলো সবিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। তার লেখা ও সুর করার ভিন্ন ধারার গানগুলো আজও মানুষের হৃদয়ে বাজে। তার সব চলচ্চিত্রে তিনি নিজে গান রচনা করেন।
আশি থেকে নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য ধারাবাহিক এবং টেলিফিল্ম রচনা শুরু করেন হুমায়ূন আহমেদ। ১৯৮৩ সালে তার প্রথম টেলিভিশন কাহিনীচিত্র ‘প্রথম প্রহর’ বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। এটি তাকে রাতারাতি জনপ্রিয় করে তোলে। পরবর্তী সময়ে তিনি ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘আজ রবিবার’, ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’র মতো বহু পর্বের ধারাবাহিক নাটক নির্মাণ করেছেন, যা বছরের পর বছর মানুষকে টিভির পর্দায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। এ ছাড়াও ‘হিমু’, ‘নিমফুল’, ‘খেলা’, ‘অচিন বৃক্ষ’, ‘খাদক’, ‘একি কাণ্ড’, ‘একদিন হঠাৎ’, ‘অন্যভুবন’, ‘মৃত্যুর ওপারে’, ‘দ্বিতীয়জন’, ‘নীতু তোমাকে ভালোবাসি’, ‘সমুদ্র বিলাস প্রাইভেট লিমিটেড’, ‘পুষ্প কথা’, ‘হাবলঙ্গের বাজার’, ‘তারা তিনজন’, ‘জুতা বাবা’, ‘মন্ত্রী মহোদয়ের আগমন শুভেচ্ছা স্বাগতম’-এর মতো অসংখ্য জনপ্রিয় একক নাটক নির্মাণ করেছেন।  

টেলিভিশনের জন্য একের পর এক দর্শক-নন্দিত নাটক রচনার পর হুমায়ূন আহমেদ ১৯৯০-এর গোড়ার দিকে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। তার পরিচালনায় প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’ মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে। ২০০০ সালে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ও ২০০১ সালে ‘দুই দুয়ারী’ চলচ্চিত্র দুটি প্রথম শ্রেণির দর্শকদের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়। ২০০৩-এ নির্মাণ করেন ‘চন্দ্রকথা’ নামে একটি চলচ্চিত্র। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ২০০৪ সালে নির্মাণ করেন ‘শ্যামল ছায়া’ চলচ্চিত্রটি। এটি ‘সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র’ বিভাগে একাডেমি পুরস্কারের জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। এ ছাড়াও চলচ্চিত্রটি কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। ২০০৬ সালে নির্মাণ করেন ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’। ২০০৮ সালে নির্মাণ করেন ‘আমার আছে জল’। ২০১২ সালে তাঁর পরিচালনার সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘ঘেটুপুত্র কমলা। ’ এরপর আর ক্যামেরার পেছনে দেখা যায়নি ক্যামেরার জাদুকরকে।

হুমায়ূন আহমেদের লেখা উপন্যাস অবলম্বনেও নির্মিত হয়েছে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র, যেগুলো তুমুল দর্শকপ্রিয়তা পায়। এর মধ্যে ১৯৯২ সালের মুস্তাফিজুর রহমান পরিচালিত ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ২০০৬ সালে মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত ‘দূরত্ব’, বেলাল আহমেদ পরিচালিত ‘নন্দিত নরকে’ এবং আবু সাইদ পরিচালিত ‘নিরন্তর’। ২০০৭-এ শাহ আলম কিরণ পরিচালিত ‘সাজঘর’ এবং তৌকীর আহমেদ নির্মাণ করেন বহুল আলোচিত চলচ্চিত্র ‘দারুচিনি দ্বীপ। ’ 

হুমায়ূনের নির্মাণ করা প্রতিটি চলচ্চিত্রই ছিল তুমুল দর্শকপ্রিয় এবং সমালোচক মহলে সর্বাধিক প্রশংসিত। মৌলিক ঘরানার চিত্রনাট্য ও গ্রামবাংলার বাস্তব জীবনের আলোকে কিংবা স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে, প্রেম-ভালোবাসা-বিরহের কালজয়ী সব চলচ্চিত্র নির্মাণে হুমায়ূন ছিলেন অনন্য এক নক্ষত্র। ক্যামেরার পেছনে হোক কিংবা লেখনীতে, হুমায়ূন আহমেদের নামটাই যেন কোটি দর্শকদের জন্য ছিল স্বস্তির, তৃপ্তির, আনন্দের। যার নির্মাণশৈলী আজও মুগ্ধ করে অগণিত ভক্ত-অনুরাগীকে। ক্যামেরার পেছনের যে জাদুকরকে আজও দর্শক স্মরণ করে শ্রদ্ধাচিত্তে।

টেলিভিশনের পর্দায় সৃজনশীলতার স্বীকৃতিস্বরূপ হুমায়ূন আহমেদ বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (শ্রেষ্ঠ কাহিনী-১৯৯৩, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র-১৯৯৪, শ্রেষ্ঠ সংলাপ-১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮), জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদকসহ অসংখ্য সম্মানজনক পুরস্কার। বাংলাদেশের বাইরেও তিনি সম্মাননা পেয়েছেন। জাপান টেলিভিশন এনএইচকে তাকে নিয়ে ১৫ মিনিটের একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করে ‘হু ইজ হু ইন এশিয়া’ শিরোনামে।

২০১২ সালের ১৯ জুলাই নিয় ইয়র্কের হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন হুমায়ূন আহমেদ। ২৪ জুলাই চিরনিদ্রায় শায়িত হন তার নিজ হাতে গড়া গাজীপুরের নুহাশপল্লীর লিচুতলায়। মৃত্যুর এক দশক পরও আন্তর্জাতিক বইমেলায় তার বই থাকে বিক্রির শীর্ষস্থানে। এখনো পাঠকের মনে হুমায়ূন উন্মাদনায় বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। এই অমর কথাসাহিত্যিক নিজের সাহিত্যের মাধ্যমেই কোটি ভক্তের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০২৩
এসআইএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।