‘ছয় নম্বর রোডের শেষ মাথায় এসে দেখবেন একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে। ঐ গাছের নিচে একটা চায়ের দোকান।
জবাব বললাম, আমাদের সমস্যা নেই। আমরাও আপনার মত...
কথাটা শুনে হাসলেন। এই প্রবীণ অভিনেত্রী। তারপর বললেন কি জানতে চাও বলো?
আপনি একজন অভিনেত্রী কিন্তু আপনার ঘরে টিভি নাই কেন বলেন তো?

প্রশ্ন শুনে টিভি রাখার জায়গাটার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন...
আমার টিভি রাখার সামর্থ্য নেই বলে।
নাকি জেদ করে টিভি রাখছেন না?
নারে না। একটা বছর হয়ে গেলো টিভি নষ্ট। আমি ছবি দেখি না।
টিভি থাকতে সিনেমা দেখতেন?
হ্যাঁ, নাটক সিনেমা, এবং বাইরের আরো কি জানি সব চ্যানেল আছে। সবই দেখতাম। যা দেখলে মন ভালো হয়। যা কিছু দেখা যায়।
আপনার সিনেমার গল্প বলেন না...
কিসের সিনেমা। আমি যদি বুঝতাম ফিল্ম আস্ত ফটকা বাজের লাইন। তাহলে লোকের বাড়ির খেতের ধান কেটে খেতাম। ধান পুড়িয়ে খেতাম। তাতেও ভালো হতো অন্তত নিজের সঞ্চয় বলে কিছু থাকতো। এখন একটা টেবলেট কেনার মত অবস্থা আমার নেই। যা তোরা বাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে দেখ। মাসের পর মাস আমি ভাড়া দিতে পারি না। অনন্যা পত্রিকা আর সাগর [ফরিদুর রেজা সাগর] যেটুকু টাকা দেয় তা দিয়েই আমি এখন চলি। এই নাকি আমি শিল্পী তোদের দেশের? এ দেশের ছবি যখন হবার কোন সম্ভাবনা নেই। এ দেশের কোন নারীরা যখন ছবি করতে নামবে না। তাদের সমাজ, ধর্ম, পরিবার বহুত কিছুর আপত্তি। সেই সময় একবারে সাঁতার দিয়ে লাফ দিয়ে ছবিতে কাজ শুরু করলাম। এর পরিমাণ কি এই? আজ আমি কোন কাজ পাবো না আজ আমার কোন অবস্থান থাকবে না। আজ আমার নামটুকু কেনই মানুষ মনে রেখেছে। তোরাই কেন আমার নাম মনে রেখেছিস। হে সম্মানি ব্যক্তিবর্গ আমার নামটা মুছে ফেল তোরা। এক্কেবারে মুছে দে।
[বলে কান্না শুরু করলেন]
ঘরটার চারদিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম, ‘আপনার সঙ্গে কারা কারা থাকেন?
এই বাসায় বড় ভাই মারা গেছে। ভাইয়ের বউটা আর দুটো মেয়ে। বড় মেয়েটা ক্লাস নাইনে পড়ে আর ছোটটা থ্রিতে। এখন এই অবস্থায় কাউকে যখন জীবনে ফেলতে পারিনি। মা বাপ ভাই বোন আত্বীয় স্বজন, এতিম এগুলো লালন পালন করছি সারাটা জীবন ধরে। আমার ছোট ভাই এবং বড় ভাইয়ের বউ ও বেটি মিলে আমরা এখানে থাকি।
এ বাসার ভাড়া দিতে হয় কত?
দশ হয়ে গেছে। ছয়ে এসেছিলাম বাড়তে বাড়তে দশ হাজার হয়েছে।
একটা সময় রেগুলার কাজ শুরু করেছিলেন। সেটা আবার বন্ধ হয়ে গেলো কেন। সেটা কি অসুস্থতার কারণে ?
গত দুই বছর ধরে আমি ঘর থেকেই বের হচ্ছি না। কারণ শরীর ভালো না।

আপনার গ্রামের বাড়ি তো সাতক্ষীরায় সেখানে যাওয়া হয় না...
অনেক দিন যাই না ওখানে। বহুকাল ধরে ঢাকাতেই আছি।
শুরুতে তো মনে হয় পুরান ঢাকার দিকে ছিলেন?
হ্যাঁ, পুরান ঢাকায় ছিলাম। ওখানেই আমার বাবা কাজ করতেন।
বিয়ে করেননি কেন?
বিয়ের চাইতেও অনেক বড় একটা বিষয় ছিলো আমার জীবনে। পুরুষেরা নারী ছাড়া তাদের সুখের সংসার করতে পারে না। সুখ কাকে বলে তারা বুঝতে পারে না, খুঁজে পায় না। আর বিদেশের কথা আলাদা। যার যার মত সে থাকতে পারে। সে সামর্থ্য ও ক্ষমতা তাদের আছে। কিন্তু আমাদের দেশের কথা আলাদা। সামাজিক অবস্থা দেশের পরিস্থিতি সব কিছু মিলিয়ে নারীর জীবনে অবশ্যই কিছু থাকা দরকার। একজন সঙ্গী দরকার। বাপ-মা ভাইয়ের পর মেয়েদের পাশে কে এসে দাঁড়াবে? দাঁড়াবে স্বামী। স্বামীর পরে কে এসে দাঁড়াবে? তার সন্তানেরা। তার সমাধিটা তার সন্তানের হাতে হবে। আমি যদি সংসার করতাম বিয়ে স্বাদী করতাম তাহলে পাঁচ ছয়টা এতিম ছেলে মেয়ে পালতে পারতাম না। যারা আমার রক্তের সম্পর্কের। আর আমার মায়ের জন্য আমি বিয়ে করিনি। আমার সম্ভব হয়নি মাকে ছেড়ে যাওয়া।
আপনার কি তাহলে কোন পছন্দের মানুষ ছিলেন?
পছন্দের মানুষ থাকা তো স্বাভাবিক। এটা বাস্তব। কিন্তু পছন্দের মানুষ থাকলেই যে নিজের মাকে ত্যাগ করে যেতে হবে এটা আমি মানতে পারি না।
বিয়ে তো মানুষ শুধু সংসারের কারণেই করে না...
তা করে না। আমি ফিল্ম লাইনে তা দেখেছি। আমার ওসব ভালো লাগে নি।
আপনি এক সময় বাংলা ছবির নিয়মিত শিল্পী ছিলেন। ব্যস্ত থাকতেন শুটিং নিয়ে। এখন ফিল্মে কাজ করতে পারছে না। এখন সেই নাম-ডাক নেই। বা সে কদরও পাচ্ছেন না এটা কি মানসিক যন্ত্রণা দেয় না?
এটা কি আমার হতাশা নাকি বাস্তবতা? আমার বয়সের সঙ্গে আমাদের ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে যুক্ত। যদি তাই হয় বয়স যদি কারো বেড়ে যায় বা বার্ধক্য আসে তাহলে কি সে বাদ পড়ে?
বাদ পড়ে না। তাকে হয়তো আর সে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করতে দেওয়া যায় না?
নায়িকা হবার দরকার নেই। বিদেশে, ভারত বা হলিউডে, দেখা গেছে কিছু শিল্পী আমার চেয়েও বয়স বেশি লাঠি ভর দিয়ে টুক টুক করে অভিনয় করছেন। তবুও তারা কাজ করছে। কাজ করে খাচ্ছে। তাদের যে পরিচিতি, তার যে সম্মান তার তুলনা হয় না। আমাদের দেশে এত নীচ মানসিকতার মানুষ কেন সবাই? আমার মত একটা শিল্পীকে বাঁচিয়ে রাখার কি ক্ষমতা নেই এই শিল্পী সমাজের।
হয়তো আছে?
আছে, কিন্তু কার কাছে যাবো, কোন সমিতির কাছে যাবো, কে আমাকে লাথি মারে না গুতো মারে। আর সত্যি কথা বলতে কি, যে কটা দিন বেঁচে থাকি নিজের মত থাকতে চাই। দরকার নাই এত আলোচনার।

[বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন] কেন না? আমার বয়সী কোন চরিত্র কি এখন নাই? তোরা আমাকে এত সহজে ভুলে গেলি। আমি অ্যাক্টিং পারবো কি পারবো না এটা তো পুরাতন শিক্ষা। ঠিক আছে পাঠ দিও না, কিন্তু আমি যে তোমাদের এত দিলাম। তার কি প্রতিদান দিলে তোমরা?
[কথাটা বলে একটু চুপ মেরে গেলেন। হতাশ ফুটে উঠলো চোখে মুখে। মন খারাপের কথা আর না। প্রসঙ্গ পাল্টানো দরকার]
আপনার যারা নায়ক ছিলেন বা যে নায়কদের সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব ছিলো তাদের সম্পর্কে যদি বলতেন?
আমার নায়ক তো সবাই, আমি যে ধরনের অভিনয় করতাম সেখানে সবাই আমার নায়ক।
মঞ্চে কাজ করেই তো শুরুটা হয়েছিলো আপনার ?
হ্যাঁ, মঞ্চেই নিজের চোখে প্রথম অভিনয় দেখি। মঞ্চেই কাজ শুরু না বুঝে।
আপনাদের সময়ে ফিল্মে পারিশ্রমিক ছিলো কেমন?
সেই তো কথা [বলে মাথা দুলালেন] ৭০-৭৩ সাল পর্যন্ত ফিল্মে তেমন কোন পারিশ্রমিক ছিলো না। তখন পাঁচশ টাকা থেকে ৮শ এক হাজার টাকা পেতাম।
জহির রায়হানের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ?
‘কাঁচের দেয়াল’ সহ আরো জানি কি ছবি করলাম আরে...এখন তো মনে করতে পারছি না। তবে তিনি মানুষ হিসেবে খুবই ভালো মনের মানুষ ছিলেন। কত কথা সব মনে পড়ে না। বয়স হয়েছে তো!
[এর মাঝে একজন দোকান থেকে কিনে আনা চা ও বিস্কুট দিয়ে গেলেন। রানী সরকার আমাদের চা নেওয়ার তাগিদ দিলেন। চায়ে চুমুক দিয়ে বলি...
একটা ইচ্ছে থাকে না মানুষে, যেটা পূরণ হয় না...
বলে লাভ আছে, মানুষ হাসবে, আমি মারা গেলে মানুষ টিটকারি করবে। রানী ফিল্ম প্রোডাকশন করার ইচ্ছে ছিলো। খুব খারাপ হতো কী? আমি করে যেতে চেয়েছিলাম এটা থেকে আমি কতটুকু কি পেলাম সেটা না। আমি বেঁচে থাকলাম নামে আর আমার পরিবারের লোকজন এখান থেকে আর্থিক সহায়তা পেল। সে কাজটাও করা হলো না।

আমাদের দেশ নিয়ে আপনার কি চিন্তা বলেন তো?
আমি কিন্তু রাজনীতির মানুষ না। রাজনৈতিক কোন ব্যাপার আমার জানা নেই। রাজনৈতিক কথা কিন্তু আমার কাছে খুব একটা সুবিধা হবে তা আমি বলবো না। দেশ থাকলেই রাজনীতি থাকবে। আমরা কি করে বাঁচবো। গরিব দু:খি অসহায়। আমি তুমি বললেই তো দেশের বর্তমান অবস্থা থেমে যাবে না। কিন্তু এগুলোর পরিণতি খুব খারাপ হচ্ছে। মানুষ না খেয়ে মরছে, কাজে বের হতে পারছে না, যারা জোর করে বেরুচ্ছে তারা মরে পড়ে থাকছে রাস্তায়।
আপনি এখন কি ধরনের ছবি দেখতে চান আমাদের হলে?
বাস্তবমুখী, কই এখন তো আর বাস্তবমুখী ছবি হয় না। লাইফের গল্প আমাদের দেশের বাস্তবমুখী গল্প ছবিতে দেখা যায় না। ‘কাঁচের দেয়াল’, ‘চোখের কাজল’, ‘চান্দা’, ‘আনোয়ারা’ এসব ছবিগুলো দেখা উচিত আবার।
ইন্ড্রাস্ট্রিতে আপনার প্রিয় মানুষ কে ছিলো?
একটা কথা বলবো?
বলেন...
ঐ পুরো ইন্ড্রাস্ট্রিটাই ছিলো আমার প্রাণের মাঝে। কার নাম বলবো। সবাই আমার আপন ছিলো। তারা আমাকে আপন মনে করুক আর না করুক। আমি তাদের আপন মনে করি। এফডিসির সকল শ্রেণী পেশার মানুষ আমার প্রাণের মানুষ ছিলো। চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
[চায়ের কাপ হাতে নিলাম। নূর ছবি তুলে যাচ্ছে। তার মত করে। ]
দেশের শিল্প-সাহিত্য কোন দিকে যাচ্ছে বলেন তো?
আমার মনে হচ্ছে সব জায়গায় ব্যবসা ঢুকে গেছে। এখানে বাস্তবের সম্পর্ক কম।
ব্যবসা না করলে ইন্ড্রাস্ট্রি টিকবে কি করে ?
আমরা যখন সিনেমা করতাম তখন কিছুই ছিলো না। তখন ‘চান্দা’ ‘তালাশ’ এর মত ছবি কি করে হলো? ‘অরুণ বরুণ কিরণমালা’য় তো এত রঙবাজি রাখে নাই। এমন কোন বাজে রংঢং রাখে নাই। এখন সব কাজে এত রং লাগায়। কেন বুঝি না।
ডিজিটাল ছবি হচ্ছে এটা কি ভালো না?
ভালো হয়েছে, কিন্তু ভালো রাখা আমাদের দায়িত্ব। সবাই যদি এটাকে ভালোভাবে ব্যবহার করেন তাহলে ভালো থাকবে।
শেষ কবে সিনেমা হলে ছবি দেখেছেন?
তা বলতে পারবো না। আমি এমনিতে সিনেমা হলে ছবি কম দেখেছি। আমাদের যখন ছবি রিলিজ হতো তখন আমাদের পরিচালক সাহেবেরা ডাইকা নিয়ে আমাদের জন্য একটা ঘরোয়া শো এর আয়োজন করতো। আমরা সেখানে ছবি দেখতাম।
এখন বাসায় শুয়ে বসে আপনার কি করতে মন চায়?
কি করবো আমি? আমি তো জোর করে কারো কাছে গিয়ে বলতে পারবো না আমাকে একটা বুড়ির চরিত্র দাও। কিছু দুঃখ ব্যাথার সঙ্গে ভাগ মিলিয়ে চলছি। এই দুঃখগুলো ব্যাথাগুলো আমার প্রাণের।
[বলে আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে লাগলেন। দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনে আবার অন্য প্রসঙ্গে চলে যেতে হল]
আপনার ডাক নাম তো মেরি এমনিতে আপনার পুরো নাম কী?
এই বলে লাভ আছে? মোছাম্মত আমিরুন নেসা খানম। রানী সরকার হচ্ছে ফিল্মের নাম, মোস্তাফিজ ভাইয়ের দেওয়া। এখন আমার জীবন বাঁচার পথ কী? আপনারা তো আপনাদের কাজ করে গেলেন। আমার কী হবে? আমার ভাত কাপড়ের ব্যবস্তা কী হবে, কেমন করে হবে, কি করে বাকিদিনগুলো আমি বেঁচে থাকবো?
[বলে কান্না করতে থাকলেন রানী সরকার]
আপনি যে টাকা ইনকাম করেছেন। সেগুলো কি করেছেন?
ফিল্মে যখন টাকা আসলো তখন তো আমরা আর নাই। আমি তো চারশ পাঁচশ টাকা পেতাম যখন কাজ করতাম। তা দিয়ে আমার বাবা, মা, ভাই বোন সবাইকে চালিয়েছি। নিজের জন্য তো কিছু করিনি জীবনে।
কোথাও বেড়াতে যেতে মন চায় না?
কোথায় যাবো? আমার আর কোথাও যেতে ভালো লাগে না। এই পৃথিবীটাকে আর ভালো লাগে না। এটা একটা মিথ্যার জায়গা।
সত্য তাহলে কী?
সত্য জন্ম আর মৃত্যু।
মৃত্যুকে ভয় পান...
ভয় পেয়ে লাভ নেই। মৃত্যুকে ভালোবাসাটাই বোধহয় ভালো। তাছাড়া আগামী জীবন বলতে যা বুঝায় তা কি সত্য কি মিথ্যা আমরা জানি না। আর মৃত্যু মহাশক্তি তার হাত থেকে কেউ রক্ষা পাবে না।
সারাদিন অলসভাবে বাসায় থাকার ফলে কি ধরনের চিন্তা আসে আপনার মাথায়?
কত চিন্তা আসে মাথায়।
[বলে চুপ হয়ে গেলেন। যেন কিছু ভাবছেন।
আপনি নাকি প্যাথোজ কুইন?
হ্যাঁ। আমার সিনেমার জীবন আর বাস্তব জীবন এক হয়ে গেলো এখন। আমাকে সিনেমায় প্যাথোজ কুইনও বলা হয়েছিলো কোন এক সময়।

কোথায়?
এই ধরেন কোন পার্কে অথবা চিড়িয়াখানায় গিয়ে আমরা এক সঙ্গে বসে বাদাম খেতে পারি। যাবেন আমার সঙ্গে?
[এবার হাসলেন রানী সরকার। তার কান্না দেখতে ভালো লাগছিলো না। রানীর এই হাসিটা সঙ্গে নিয়েই ফিরতে চেয়েছিলাম। রানীর হাসিমুখ দেখে নিজেরও ভালো লাগলো। রানী সরকারের মুখে এই হাসি লেগে থাকুক সবসময়।
বাংলাদেশ সময়: ২০৫০ ঘণ্টা, ০১ জানুয়ারি ২০১৪
সম্পাদনা : গোলাম রাব্বানী, বিভাগীয় সম্পাদক বিনোদন