৩৫ বছর আগে এই দিনে (২৪ জুলাই ১৯৮০ সালে) বাংলা ছবির মহানায়ক উত্তম কুমারের মহাপ্রয়াণ হয়। আজ তার ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকী।
টালিগঞ্জের উঁচু জায়গাটা ছেড়ে নেমে এলেন তিনি। নিঝুম রাত। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলেন এত রাতেও কেউ কোথাও আছে কি না। না, এমনিতেই ঘন বর্ষার মরশুম তাই লোকজনের চিহ্নও দেখা যাচ্ছে না। চারিদিক নির্জন দেখে বেশ হালকা লাগল তার। কতদিন যে খোলা হাওয়ায় হাঁটেননি তিনি। কেননা মহানায়ক হওয়ার পর থেকে লোকের ভিড়, আলোর দুনিয়া তাকে ঘিরে রেখেছে। কেউ কখনও বুঝতেও পারেনি, এই আলোর সংসারও তাকে শেষমেশ কিছু যন্ত্রণাও দিয়েছে।
একদিন জগুবাবুর বাজার থেকে একটা গোলাপ ফুল কিনতে চেয়েছিলেন এই কিংবদন্তি অভিনেতা। নিজেও গোলাপটি চেয়ে পাননি। কেননা, ফুলটি কিনতে নিজে না নেমে পাঠিয়েছিলেন তার ড্রাইভারকে। কিন্তু ড্রাইভার সঠিক ফুলটি আনতে পারেননি।
একবার এক আত্মীয়র বিয়েতে মাঝ রাতে গিয়েও সে কী ভিড়। এই বোধহয় দেওয়াল ভেঙে যায় যায়! কেননা মহানায়ক এসেছে বলে এই ভিড়। বম্বের এক পরিচালক উত্তম কুমারের কাছে জানতে চেয়েছিলেন কেন তার পারিশ্রমিক এত বেশি। তিনি সোজা তাকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন মেয়েদের একটি স্কুলের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে সবে সিগারেট ধরিয়েছেন, অমনি হু হু করে ভিড়। আর কিছুই বলতে হয়নি তাকে। পরিচালকের ততক্ষণে বুঝে গিয়েছিলেন, যে তার পারিশ্রমিক বেশি কেনো। এই মহায়নায়ক তো তাই সবাইকেই বলতেন, নায়কদের এত বেশি প্রকাশ্যে আসতে নেই।
তিনি কি শুধু একজন অভিনেতা? কত দাপুটে অভিনেতাকেই তিনি দেখেছেন। কিন্তু সকলেই তো তিনি নন। কী করে যেন তিনি একটু একটু করে মহানায়ক হয়ে গেলেন। সিনেমার ইতিহাস বলবে, স্বাধীনতাত্তোর সময়ে বাঙালির চাওয়া-পাওয়া, স্বপ্নপূরণের সওদাগর ছিলেন তিনিই। সাধারণ থেকেও অসাধারণ হয়ে ওঠার যে ক্ষমতা ছিল তার চরিত্রদের, তাই বোধহয় ছিলো একটা গোটা জাতির প্রত্যাশা।
বলা বাহুল্য বাঙালির জন্য তিনিই ছিলেন সেই মানুষ। তাকে বাদ দিয়ে তাই শুধু সিনেমা নয়, বাঙালির ইতিহাসও অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আরও গভীরে বিশ্লেষণ করে কেউ কেউ বলবেন, তিনি বা তার ছবি সামাজিক পরিসরকে কোনও প্রশ্নের মুখে ফেলে না। একধরনের স্বস্তি তিনি দেন, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিরতা যাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় না।
স্টুডিওপাড়ার দরজাগুলো এখন বন্ধ। একদিন তার জন্যও তো এসব বন্ধ ছিল। তাকে দেখে কেউ কেউ বলেছিল, ‘এ কলির ভীমকে কোথা থেকে পেলেন? পায়ে পাথর বেঁধে না রাখলে ঝড় দিলে উড়ে যাবে যে। ‘ সত্যজিতের অপুর্ব কুমার রায় যখন কলকাতায় এসেছিল, তখন তার সঙ্গে সাহিত্য ও সিনেমা সংস্কৃতির যে আভিজাত্য জড়িয়ে ছিল, উত্তমকুমারের চরিত্র তা পায়নি। কিন্তু গ্রাম থেকে শহরে আসার এক কাহিনিতেই সাধারণের পায়ের তলায় মাটি পাওয়ার যে কথা তার মাধ্যমে উঠে এল পর্দায়, তার মধ্যে ছিল উপকথা রচনার উপাদান। বস্তুত সেই শুরু শাপমোচনের। একদিন সেই ‘কলির ভীম’ই সত্যজিতের নায়কের জন্য ‘নির্বিকল্প’ হয়ে উঠবেন। জয় তো আসলে দুটো। এক, অভিনেতা হিসেবে তার ব্যক্তিগত উত্তরণ। আর দ্বিতীয়ত সাংস্কৃতিক ইতিহাসও যে স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসে এই লৌকিক কিংবদন্তির গায়ে কৌলিন্যের ছাপ লাগিয়ে দিল, তা আসলে যেন সাহিত্যের ইতিহাসে মঙ্গলকাব্যের অন্তর্ভুক্তিরই সমতুল্য। আর এসব হয়েছে তাকে ঘিরেই। তিনি বোধহয় জানতেনই, ভাবীকালের ইতিহাস অনেকসময়ই এ সব ওভারলুক করে যাবে। কিন্তু তিনি তো উত্তমকুমার। তিনি কী করে এড়াতে পারবেন। কেননা, তিনি তো এতদিনে ইতিহাসের ধ্রুবতারা হয়ে গিয়েছেন। বাস্তবের মাটিতে যার নেমে আসা মানা।
বেশ খানিকটা ঘোরাফেরার পর তিনি ফিরে এলেন তার মূর্তির কাছে। ভোরের আলো ফুটছে। সকাল হতে না হতেই, তার চলে যাওয়ার সাড়ে তিন দশক পরেও কত মানুষের ভিড় জমাবে এখানে। মালা-টালা আর ভালো লাগে না। মনে হয়, ফুলগুলো সব পাথর। বলতে ইচ্ছে করে, ওগুলো সরিয়ে নাও আমার লাগছে। কিন্তু যারা মালা দিতে আসেন তাদের যদি একজনেরও খাঁটি ভালোবাসা থাকে, সে মূল্য তিনি মেটাবেন কী করে? তিনি তো আজীবন বলে এসেছেন, ‘আমি ভালোবেসেছি আপনাদের। ’ সে ভালোবাসা তিনি ফেলতে পারেন না। বাঙালি জানে, তিনিও জানেন, আর কেউ নন, শুধু তিনিই পারেন বাঙালির এক ও অদ্বিতীয় মহানায়ক হয়ে উঠতে এবং হয়ে থাকতে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৯ ঘণ্টা, জুলাই ২৪, ২০১৫
বিএসকে