ঢাকা, সোমবার, ২২ আশ্বিন ১৪৩১, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৩ রবিউস সানি ১৪৪৬

বিনোদন

ফরিদা পারভীনের সঙ্গে কিছুক্ষণ

‘হ্যাট বা হাফপ্যান্ট পরে গাইলেই হবে না’

সোমেশ্বর অলি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১৫
‘হ্যাট বা হাফপ্যান্ট পরে গাইলেই হবে না’ ফরিদা পারভীন

দীর্ঘদিন ধরে লালনের গান নিয়ে সাধনা করছেন অনেকে। কিন্তু তার কথা আলাদা।

কয়েক দশক ধরে দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক দরবারেও সাফল্যের সঙ্গে লালনের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। সংগীত জীবনে পেয়েছেন বহু পুরস্কার। তিনি ফরিদা পারভীন। বাউল সাধক লালনের মৃত্যুবার্ষিকী আগামী ১৬ অক্টোবর। তার স্মরণে বাংলাভিশনের ‘মিউজিক ক্লাব’ অনুষ্ঠানে আগামীকাল বুধবার (১৪ অক্টোবর) রাত ১১টা ২৫ মিনিটে গান গেয়ে শোনাবেন তিনি-

বাংলানিউজ : এবার লালনের কোন কোন গানগুলো পরিবেশন করবেন?
ফরিদা পারভীন : কোন গান গাইবো সেটা ঠিক করা থাকে না। টেলিফোনে দর্শকদের অনুরোধে সাঁইজির গান করবো। চেনা-অচেনা সব ধরনের গানই করতে হয় এ ধরনের অনুষ্ঠানে।

বাংলানিউজ : তরুণদের মধ্যে অনেক শিল্পী লালনের গান গাইছে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে চর্চাটা কেমন দেখছেন?
ফরিদা : এখনকার পিতা-মাতাদের অনেকে চান তাদের শিল্পী হতে চাওয়া সন্তানেরা লালনের গান করুক। কিন্তু সেটা কী হচ্ছে? আমি মনে করি এখনকার ছেলেমেয়েরা, যারা গাইছে, সবার কণ্ঠ ভালো। কিন্তু আমার জানতে ইচ্ছে করে, তারা সঠিকভাবে গান গাইতে চাইছে না, নাকি গাওয়ার বাসনা নেই?

বাংলানিউজ : এখন তো লালনের গানকে নতুনভাবেও উপস্থাপন করা হচ্ছে!
ফরিদা : শুরুতে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতাম না। দীর্ঘদিন চুপ থেকেছি। এখন বলি। আগামী প্রজন্মকে লালনের গানের মাহাত্ম্যটা জানাতে হবে, এ কারণেই বলি। সত্যি বলতে, সাঁইজির কালাম বা বাণী নতুনভাবে উপস্থাপন করার কিছু নেই। তার বাণী চিরনূতন। তার গান গুরু-শিষ্য পরম্পরার বিষয়। হ্যাট বা হাফপ্যান্ট পরে গাইলেই হবে না। এভাবে গানগুলোকে নষ্ট করা যাবে না। লালন ছিলেন আধ্যাত্মবাদের কবি, মরমী কবি। তার বাণীতে ভাব বেশি, ভড়ং নেই। আর লালন জীবদ্দশায় সাদা কাপড় পরিধান করতেন। কে না জানে সাদা হচ্ছে পবিত্রতার প্রতীক! আমি মনে করি, লালনের বাণীর শুদ্ধতা রাখতে সচেতন হতে হবে নতুন প্রজন্মকে।

বাংলানিউজ : লালনের গান তো এখন বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। এর পেছনে আপনার অবদান অনেক…
ফরিদা : এই অঞ্চলে যারা ফকিরা গান করেন তারা এক সময় লালনের ধামেই সীমাবদ্ধ ছিলেন। এখন তার গান বিস্তৃত হয়েছে। আমার গুরু, যিনি আমাকে তৈরি করেছেন, সেই মোকশেদ আলী সাঁইয়ের কল্যাণে নাগরিক জীবনে লালনের গান করছি আমি বা আমরা। আমি গুরু ধরে শিখেছি। কণ্ঠশৈলী দিয়ে তার গানগুলোকে নান্দনিকভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করছি। কতোটা পেরেছি জানি না!

বাংলানিউজ : লালনের ‘আশা পূর্ণ হলো না’ গানের সুর ধরে জানতে চাই, আপনার কোন আশা এখনও পূর্ণ হয়নি?
ফরিদা : জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনের যে আকুতি, লালন গানে গানে সেই কথা বলেছেন। একইভাবে বলেছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে শুরু করে আব্দুল করিমও। তাদের বলার ধরণটা আলাদা। কিন্তু লক্ষ্য একই, পরমাত্মার সন্ধান। দুনিয়ার এই বৈভব, ঝকমারি কিছু নয়। পরমেশ্বরের সাথে জীবাত্মার একাত্মতা চাই। এটা হয়ে গেলে অপূর্ণতা বলে কিছু থাকে না। লোভ লালসার উর্ধ্বে উঠতে পারা যায়। আমি লালনের বাণীকে ধারণ করেছি। জীবনব্যাপী তার বাণী নিয়েই আছি। এভাবেই থাকবো জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।

বাংলানিউজ : ফরিদা পারভীন ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম কেমন চলছে?
ফরিদা : তেজকুনি পাড়ায় একটি ছোট্ট বাসা নিয়ে ফরিদা পারভীন ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম পরিচালনা করছি। আশা রাখি, ভবিষ্যতে এর পরিসর বাড়বে। ইতিমধ্যে আমার গাওয়া লালনের গানের ২৫টি স্বরলিপি নিয়ে বই বেরিয়েছে। মোট তিন খন্ডে ১০০টি স্বরলিপি গ্রন্থভুক্ত হবে। আমার সহায়তায় এই কাজটি করছেন মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী। আমার ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে লালনের গানের পাশাপাশি, লোকজ গান, দেশীয় ও বিলুপ্তপ্রায় বাধ্যযন্ত্র- প্রভৃতি নিয়ে একটি আর্কাইভ তৈরির পরিকল্পনা আছে। এখানে যেসব ছেলেমেয়েরা পড়ছে, লালনের বাণীর দীক্ষা নিয়ে তারা শুধু ভালো গানই করবে না- শুদ্ধ মানুষও হবে। সহজ মানুষ হওয়ার পাঠ দেওয়া হচ্ছে তাদের। আমি মনে করি- সহজ মানুষ হওয়া কঠিন, আর কঠিন মানুষ হওয়া সহজ।

বাংলানিউজ : সংগীতে আপনার যাত্রা শুরু হয়েছিলো নজরুলসংগীত ও আধুনিক গান দিয়ে। কিন্তু খ্যাতি পেয়েছেন লালনের গানে। আপনি এমনটাই ভেবেছিলেন?
ফরিদা :  আল্লাহর অভিপ্রায় ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়। শুরুর দিকে আমি আমার গুরুকে বলেছিলাম ফকির-ফাকরার গান আমি করবো না। পরে আমার মধ্যে সঠিক উপলব্ধিটা দিয়েছেন আমার পরমেশ্বর।

বাংলানিউজ : আপনি গান গেয়ে বিভিন্ন পুরষ্কার পেয়েছেন। আপনার জীবনের সেরা প্রাপ্তি কী?
ফরিদা : পুরস্কারের বাইরের প্রাপ্তিই আসল প্রাপ্তি। আমি খু্ব আনন্দবোধ করি যখন গান শোনার পর শ্রোতাদের অনেকে আমার পা ছুঁয়ে সালাম করে। তারা আমাকে ছুঁয়ে দেখতে চায়। এটা দারুণ প্রশান্তি এনে দেয় মনে। আমি যখন ভেতর থেকে গানের তাগাদা পাই না তখন বিমর্ষ হয়ে পড়ি। এ ধরণের প্রাপ্তিগুলো তখন বেশ সাহস যোগায়। আর আমি লালনের সব গান গাই না। গাইতে পারি না। ভেতর থেকে আর্জি না এলে গান গাওয়া সম্ভব হয় না।

বাংলানিউজ : আপনার সমসাময়িক অনেক গুণী মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। মৃত্যু মানুষের জীবনের অমোঘ সত্য। মৃত্যুচিন্তা হয় আপনার?
ফরিদা : শুধু ভয় হয়, আমার পরমেশ্বরের সান্নিধ্য পাবো তো! আমি মনে করি মানুষের শৃঙ্খলিত জীবন তাকে সুন্দরভাবে পরিচালিত করতে পারে। সঠিক পথে চললে মুত্যুভয় থাকে না।

বাংলানিউজ : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার সু্স্থ ও দীর্ঘজীবন কামনা করছি।
ফরিদা: তোমাকেও ধন্যবাদ। ভালো থেকো।

বাংলাদেশ সময় : ১৮২৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১৫
এসও/জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।