ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

বিনোদন

গণহত্যার লোমহর্ষক গল্পে ‘হননকালের প্রত্নপুরান’

স্বপন চন্দ্র দাস, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩১ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০২২
গণহত্যার লোমহর্ষক গল্পে ‘হননকালের প্রত্নপুরান’

সিরাজগঞ্জ: একরাশ হতাশা আর চোখমুখে আতঙ্ক নিয়ে খেঁটে খাওয়া মানুষগুলো জড়াজড়ি করে বসেছিল বিদ্যালয়ের কক্ষে। বিপরীত প্রান্ত থেকে বুটের খট-খট আওয়াজ ভেসে আসছিল।

বুটের আওয়াজ তীব্রতর হতেই নিঃশব্দে সংকুচিত হচ্ছিল আতঙ্কিত মানুষগুলো। হঠাৎ ভয়ংকর অট্টহাসিতে একদল পাকসেনা ঢুকে পড়ে। সঙ্গে তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরেরা। বেয়নেট, চাপাতি, কোদাল, তলোয়ার নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র মানুষগুলোর ওপর। নরপিশাচগুলোর অট্টহাসির মাঝে মিলিয়ে যায় সাধারণ মানুষের মরণ চিৎকার।

শুক্রবার (২৯ জুলাই) রাতে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার বাগবাটি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রদর্শিত ‘হননকালের প্রত্নপুরান’ নাটকে গল্পের শুরুটা ছিল এমনই। নাটকের প্রতিটি দৃশ্য এতটাই শ্বাসরুদ্ধকর ছিল যে কয়েক হাজার দর্শক নিরব নিস্তব্ধ হয়ে উপভোগ করেছে ঐতিহাসিক এ নাটকটি।  

নাটকটির মাধ্যমে ১৯৭১ সালে নিরীহ বাঙালির ওপর পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের লোমহর্ষক চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে সিরাজগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমির অভিনেতারা।  

নাটক শেষ হবার পর অনেককেই চোখ মুছতে দেখা যায়। বৃদ্ধ, প্রৌঢ় থেকে শুরু করে শিশু-কিশোরদের চোখও ছলছল করছিল। এ যেন তাদেরই পুর্বসূরীদের গল্প। নাটক শেষে কথা হয় বিভিন্ন শ্রেণীর দর্শকদের সঙ্গে। সকলেই বলছিলেন, এমন হৃদয় বিদারক নাটক আগে দেখেননি।  

দত্তবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা ও বাগবাটি ডিগ্রি কলেজের প্রথমবর্ষের ছাত্র ফিরোজ আহমেদ বলেন, বাপ-দাদার কাছে বাগবাটি গণহত্যার গল্প যেমনটা শুনেছি, এখানে যেন তেমনটাই দেখলাম। তার কথায় সায় দেয় একই সহপাঠী আহমেদ শাকিল ও রাসেল। এ তিন কলেজছাত্র যেন মুহুর্তেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছে। তাদের ভাষ্য, জীবনে এত সুন্দর নাটক দেখিনি।  

বাগবাটি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী চক মিরাখোর গ্রামের জিহাদ ও ইদ্রিস হোসেনসহ অনেক শিক্ষার্থী বলে নাটকটি অসাধারণ লেগেছে। এখানে বধ্যভূমির কথা দাদাদের কাছে শুনেছি। আজ নাটকের মাধ্যমে বুঝলাম।  

কয়েক কিলোমিটার দূর সীমান্ত বাজার নামক স্থান থেকে এসেছিলেন বেসরকারি চাকরীজীবি নিজাম উদ্দিন। অশ্রুসজল নয়নে তিনি বলছিলেন, সত্যি আমার কান্না পেয়েছে। কতটা নির্মম ছিল পাক বাহিনী ও রাজাকারেরা। এ নাটকের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।  

জাহানারা খাতুন নামে ষাটোর্ধ নারী বলেন, বাবাগো আমি তহন ১০ বছরের আচিলাম। তহন বাপ-মায়ের মুহের দিকে চাওয়া যাই নাই। খালি ভয়ে ভয়ে থাইকতো। বড়গোরে দেইহ্যা আমাগোরে মুহেও কতা আচিল না। এই নাটকে হেইসব দৃশ্য দেইহ্যা চোহে পানি আইস্যা গেছে।  

বাগবাটি গ্রামের তাঁত শ্রমিক রবিউল ইসলাম, আল-আমিন, অটোরিকশা চালক আব্দুর রাজ্জাকসহ অসংখ্য সাধারণ মানুষের মুখে যেন একই কথা, ‘বাব-দাদাদের মুখে শোনা ঘটনাই নাটকের মধ্যে দেখানো হয়েছে। ’ 

গ্রাম পুলিশ সুবোধ চন্দ্র দাস বলেন, যুদ্ধের সময় আমার বয়স ১৫/১৬ বছর। আমি অনেক কিছুই দেখেছি। আজকের নাটকের মাধ্যমে সেই চিত্রটা আবারো দেখলাম।  

শহর থেকে নাটক দেখতে আসা বীর মুক্তিযোদ্ধা কোরবান আলী বিন্দু ও আব্দুল মালেক বলেন, এ যেন বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে। যতক্ষণ নাটক দেখেছি মনে হয়েছে আমরা যেন একাত্তরেই রয়েছি।  

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ২৭ মে বাগবাটি এলাকায় প্রবেশ করে পাক হানাদার বাহিনী। স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় এ অঞ্চলের ২ শতাধিক হিন্দু-মুসলমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে তারা। গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে, কোদালে কুপিয়ে, গাছের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়ে এবং জবাই করে এসব মানুষকে হত্যা করা হয়। সেদিনের সেই চিত্রটি ফুটিয়ে তুলতেই এ পরিবেশ থিয়েটার মঞ্চায়ন করা হয়। যেখানে গণহত্যা হয়েছে সেই স্কুলটিকেই স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে।  

জেলা শিল্পকলা একাডেমি সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পৃষ্ঠপোশকতায় গণহত্যার পরিবেশ থিয়েটারের আওতায় নাটকটি রচনা করেছেন মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম। পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা ও নির্দেশনায় ছিলেন জেলা কালচারাল অফিসার মাহমুদুল হাসান লালন। নাটকটির চরিত্রায়নে ছিলেন জেলা শিল্পকলা একাডেমীর ৫০ জন অভিনেতা-অভিনেত্রী। কুশীলবে ছিলেন আরো ৩০ জন। প্রায় তিন হাজার দর্শক নাটকটি উপভোগ করেছে।  

নাটকটির নির্দেশক ও জেলা কালচারাল অফিসার মাহমুদুল হাসান লালন বলেন, পরিবেশ থিয়েটারের অর্থ হলো, ঘটনাটি যেখানে ঘটেছিল, ঠিক সেখানে সেই আবহ সৃষ্টি করেই নাটক মঞ্চায়ন। ১৯৭১ সালের ২৭ মে বাগবাটির গণহত্যার ঘটনাটি ছিল সিরাজগঞ্জের সবচেয়ে লোমহর্ষক ঘটনা। এ ঘটনাটি নিয়েই ছিল নাটক। শিল্পকলা একাডেমির ৫০ জন পারফরমার টানা দুই মাস রিহার্সেল করে নাটকটি প্রস্তুত করা হয়েছে। যে স্কুলটিতে গণহত্যা হয়েছিল, তার পুরো মাঠটিকেই মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। নাটক মঞ্চায়নের আগে ওই গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী এবং বেঁচে যাওয়া স্বাক্ষীদের সঙ্গে অভিনেতারা কথা বলেছেন।  

নাটকটির লেখক বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম বলেন, নাটকটি দেখতে কয়েক হাজার মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করে মানুষ মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে চায়। মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনে প্রত্যেকটা মানুষের চোখ ছলছল করে। কিন্তু আমরা যারা গল্প বলি সেটা আমাদের নিজের গল্প যা জনগনের সঙ্গে মেলে না। যার ফলে মনে হয় জনগন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী হয়ে যাচ্ছে। গল্প হতে হবে জনগনের গল্প, তাদের কাছে গল্প। যাতে খুব সহজেই মানুষ গ্রহণ করবে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তারা মাঠে নামবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩১ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০২২
এনএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।