ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

মাটি ও বাঁশের অন্যরকম এক স্কুল

সানি সরকার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১০
মাটি ও বাঁশের অন্যরকম এক স্কুল

দিনাজপুর মেটি স্কুল। এর খ্যাতি মাটি ও বাঁশ দিয়ে তৈরি ভিন্নধর্মী নির্মাণশৈলীর জন্য।

আর এ কারণেই ২০০৭ সালে পেয়েছে আগা খান আর্কিটেকচার অ্যাওয়ার্ড। স্কুলটির অবস্থান দিনাজপুরের বিরল উপজেলার মঙ্গলপুর ইউনিয়নে রুদ্রাপুর গ্রামে। রুদ্রাপুর বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম হলেও স্কুলটির কল্যাণে এখন দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে বিখ্যাত একটি গ্রাম। পর্যটকরা আসছেন মেটি স্কুলের নির্মাণশৈলী দেখতে।

১০ বছর আগেও এই গ্রামে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। গ্রামের ছেলে-মেয়েদের পায়ে হেঁটে যেতে হতো ৪-৫ কিলোমিটার দূরে পাশের গ্রামের স্কুলে লেখাপড়ার জন্য। এই কষ্ট লাঘব করার জন্য এবং গ্রামের শিশু-কিশোরদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে তুলতে ‘দীপশিখা’ নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ১৯৯৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর রুদ্রাপুর গ্রামের ছোট্ট পরিসরে ‘মেটি স্কুল’ গড়ে তোলে। এখানে ছাত্র-ছাত্রীদের নাচ-গান-অভিনয়-চিত্রাঙ্কন, দলীয় আলোচনা ও কথোপকথন ভিত্তিক ইংরেজি শেখানোর পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজ শেখানো হচ্ছে। বর্তমানে এই স্কুলে শিশুশ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করানো হয়।

মেটি মূলত একটি সংগঠনের নাম। পুরো নাম মডার্ন এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (মেটি)। কম খরচে এবং হাতের নাগালের জিনিসপত্র ব্যবহার করে মানুষের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে মেটি। মেটির উদ্দেশ্য আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষাদান, শিক্ষার প্রতি স্থায়ী ও ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি, যুক্তিযুক্ত চিন্তার বিকাশ ও দলীয়ভাবে শিক্ষাগ্রহণ।    

২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিরল উপজেলার রুদ্রাপুর গ্রামে মেটির অত্যাধুনিক মাটির স্কুলঘর নির্মাণ শুরু হয়, জার্মানীর ‘শান্তি’ দাতাসংস্থার অনুদানে।   অস্ট্রিয়ার লিজ ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা এ স্কুল নির্মাণে অবদান রাখেন। সহযোগিতা করেন দীপশিখা প্রকল্পের কর্মীরা। জার্মান আর্কিটেক্ট আন্না হিয়ারিংগার ও আইকে রোওয়ার্গ এর তত্ত্বাবধান করেন।

মেটি স্কুল ছয় কবিশিষ্ট মাটির তৈরি একটি দোতলা ভবন। এর আয়তন ৮ হাজার বর্গফুট। ভবনটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১৭ লাখ টাকা। অথচ ইট-সিমেন্টের এমন একটি বিল্ডিং তৈরিতে ব্যয় হবে ৯০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা। অন্যদিকে ভবনের ভেতরে রয়েছে শীতের দিনে গরম এবং গরমের দিনে ঠান্ডার ব্যবস্থা।

মেটি স্কুল নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে মাটি, খড়, বালু ও বাঁশ, দড়ি, খড়, কাঠ, টিন, রড, ইট ও সিমেন্ট। মাটি ও খড় মেশানো কাদা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এর দেয়াল, যাতে দেয়ালে ফাটল ধরতে না পারে। এছাড়া বৃষ্টির পানি দেয়ালে লাগলে খড়ের জন্য তা নেমে যাবে। দেয়াল তৈরির পর সুন্দর করে সমান করা হয়েছে। দেয়ালের ভিতের ওপর দেওয়া হয়েছে আর্দ্রতারোধক, যা মাটির নিচের আর্দ্রতা বজায় রেখে দেয়ালকে তির মুখ থেকে রক্ষা করছে।

দেয়ালের প্লাস্টারে ব্যবহার করা হয়েছে মাটি ও বালু। মেঝের প্লাস্টারের জন্য পামওয়েল ও সাবানের পেস্ট ব্যবহার করা হয়েছে, যা সাধারণভাবে ওয়াটারপ্রুফ। বাইরে থেকে প্লাস্টার না করায় স্বাভাবিকভাবে উপকরণগুলো চোখে পড়ার মতো।

মেটি স্কুলের ৯ ফিট উচ্চতার ওপরে প্রথম তলায় ছাদ হিসেবে বাঁশ বিছিয়ে ও বাঁশের চাটাই দিয়ে মাটির আবরণ দেওয়া হয়েছে। ১০ ফুট উচ্চতার ওপরে দোতলার ছাদে বাঁশের সাথে কাঠ দেওয়া হয়েছে। ওপরে বৃষ্টির পানির জন্য দেওয়া হয়েছে টিন। কোথাও ইট ব্যবহার করা না হলেও ঘরের ভীত হিসেবে ইট ব্যবহার করা হয়েছে।

জার্মান ও অস্ট্রিয়ার ১০ জন ছাত্র ও বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্থানীয় ১৯ জন শ্রমিকের সমন্বয়ে মেটি স্কুল নির্মিত হয়েছে। ২০০৭ সালে বিশ্বের ১৩টি স্থাপত্যের সাথে মেটি স্কুলকে আগা খান অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করা হয়। পুরস্কার হিসেবে দীপশিখাকে ১৩,৭০০ মার্কিন ডলার, আর্কিটেক্ট আন্না হিয়ারিংগারকে ১৬,৫০০ মার্কিন ডলার ও আর্কিটেক্ট আইকে রোজওয়ার্গকে ৮,২০০ ডলার দেওয়া।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৭১৬, অক্টোবর ২৫, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।