বেঁচে থাকার জন্য মানুষের যে পাঁচটি মৌলিক চাহিদা রেয়েছে তার মধ্যে অন্যতম শিক্ষা। ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড’ এই আপ্তবাক্যটি ছোটবেলায় আমরা সবাই পড়েছি।
আমাদের দেশে শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্যের বিষয়টি প্লে গ্রুপ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পর্যন্ত বিস্তৃত। অর্থাৎ শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্যের শুরুটা একেবারে শিক্ষাজীবনের গোড়া থেকেই। একজন অভিভাবক যখন তার ছোট শিশুসন্তানটিকে স্কুলে পাঠানের চিন্তাভাবনা শুরু করেন তখনই এর সাথে যুক্ত হয় যায় বাণিজ্য। কেননা দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা খুবই কম। যেখানে আছে সেখানেও শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে অনেক অভিভাবক সন্তুষ্ট হতে পারেন না। আর এর সুযোগ নিয়ে শহর এবং মফস্বল, এমনকি ইদানীং অনেক গ্রামেও ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে অসংখ্য কিন্ডারগার্টেন, প্রি-ক্যাডেট অথবা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। এসব কিন্ডারগার্টেন ও প্রি-ক্যাডেট স্কুলগুলোর বেশিরভাগই গড়ে ওঠে ব্যক্তিমালিকানায় এবং মূল উদ্দেশ্য অনেকাংশেই থাকে বাণিজ্যিক। এসব স্কুলে বেতন এবং পরীক্ষা/ভর্তি ফি ধার্য করা হয় অনেক বেশি। আর নানা অজুহাতে আদায় করা হয় আরও টাকা। এছাড়া বোর্ড-নির্ধারিত বইয়ের বাইরে অনেক বই যেমন বাংলা ব্যাকরণ, English Grammar, সাধারণ জ্ঞান, কম্পিউটার শিক্ষা ইত্যাদি বই পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অভিযোগ রয়েছে অনেক স্কুলেই কোনো নির্দিষ্ট প্রকাশক অথবা লেখকদের কাছ থেকে মোটা টাকা অথবা উপঢৌকন নিয়ে তাদের প্রকাশিত বই পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বোর্ড-নির্ধারিত বইয়ের বাইরে এসব বই পড়ানো অবশ্যই ভালো, কেননা এনসিটিবি (ন্যাশনাল কারিকুলাম অ্যান্ড টেক্সটবুক বোর্ড) কর্তৃক নির্ধারিত পাঠ্যক্রমে প্রাথমিক পর্যায়ে (প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী) বাংলা ব্যাকরণ, English Grammar, সাধারণ জ্ঞান, কম্পিউটার ইত্যাদি শেখার নির্দিষ্ট বই নেই। তাই এসব ভালো বই পড়ানো শিক্ষার্থীদের জন্যই মঙ্গলজনক, কিন্তু প্রকাশক অথবা লেখকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বই পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করলে এবং সে বই কিনতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করলে সে বই কতটা মানসম্মত এবং সে উদ্দেশ্য কতটা মহৎ সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তার ওপর সিলেবাস, সাজেশন, কোচিং, শিট ইত্যাদি বাবদ আরও টাকা ও ফি আদায় করা হয়। তাই সবকিছু মিলিয়ে এসব কিন্ডার গার্টেন, প্রি-ক্যাডেট স্কুলে পড়াশোনা বাবদ ব্যয় অনেক বেশি, যা অভিভাবকদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেসব এলাকায় কোনো ভাল স্কুল অথবা সরকারি প্রাথামিক বিদ্যালয় নেই, সেখানে অভিভাবকরা বাধ্য হয়েই কোনো কিন্ডারগার্টেন, প্রি-ক্যাডেট স্কুলে তাদের সন্তানদের ভর্তি করান। কিন্তু যাদের সে সামর্থ্য নেই তাদের বেশ সমস্যায় পড়তে হয়। তাই ‘সবার জন্য শিক্ষা’ স্লোগানটি এসব কিন্ডারগার্টেন, প্রি-ক্যাডেট স্কুলের ক্ষেত্র প্রযোজ্য নয়। আর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে খরচ এত বেশি যে, শুধু উচ্চবিত্ত-সন্তানরাই কেবল সেগুলোতে পড়ার সুযোগ পায়।
প্রাথমিক স্তর পার হয়ে হাইস্কুল লেবেলে (নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়) প্রবেশ করামাত্রই শিক্ষার্থীরা আরো বেশি বাণিজ্যের মুখে পড়ে। এ পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা স্কুলের শিকদের কাছে অথবা তাদের কোচিং সেন্টারে অথবা নামকরা কোনো কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয় ভালো নম্বর অথবা ভালো কোনো সাজেশন পাওয়ার আশায়। শিকদের কাছে অথবা তাদের কোচিং সেন্টারে পড়া দোষের নয়। কিন্তু অনেক শিক আছেন যারা তাদের কাছে না পড়ার কারণে শিক্ষার্থীদের কম নম্বর দেন অথবা তাদের কাছে যেসব শিক্ষার্থী পড়ে তাদের পরীক্ষার আগে সাজেশন দিয়ে দেন। তাই অনেক শিক্ষার্থী বাধ্য হয়েই শিকদের কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয় অথবা টিউটর হিসেবে রেখে বাড়িতে তাদের কাছে পড়ে। আবার অনেক শিক্ষার্থী দেশের নামকরা কোনো কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয় বিশেষ সাজেশনের আশায়। প্রতিটি ক্ষেত্রই কোচিং সেন্টার অথবা হোম টিউটরদের বেতন থাকে স্কুলের বেতনের কয়েক গুণ।
এসব কারণে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের শিক্ষা বাবদ ব্যয় অনেক বেড়ে যাচ্ছে তেমনি অতিমাত্রায় সাজেশননির্ভর হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা অনেক কিছু শেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তবে সব শিকই এমন নয়। এমন অনেক শিক আছেন যারা শিকতার মহান আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পড়ান। কিন্তু এই সংখ্যাটা এত কম যে হাতে গুনতে হবে। অনেক শিকের ভালো শিাদান পদ্ধতির কারণে অথবা বোঝাতে পারার দতার কারণে ছাত্ররা তাদের কাছে পড়তে চায়। আবার অনেক কোচিং সেন্টার আছে যেখানে ভালো শিক ও ভাল নোট/পরীক্ষার কারণে শিক্ষার্থীরা ভিড় করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এমন শিক ও কোচিং সেন্টারের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। এ তো গেল শিক ও কোচিং সেন্টারের বাণিজ্যের কথা। এমন অনেক স্কুলও আছে যেখানে ভর্তি নিয়ে, টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করা শিক্ষার্থীদের পাস করিয়ে দেওয়া নিয়ে অথবা রেজিস্ট্রেশন/ফরম ফিলআপ করা ইত্যাদি নিয়ে বাণিজ্য চলে। কখনও শিকরা আবার কখনও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্যরা এসব নিয়ে বাণিজ্য করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, এসএসসি পরীক্ষার জন্য রেজিস্ট্রেশন/ফরম ফিলআপ করতে বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত টাকার পরিমাণ বিষয়ভেদে ১০০০-১৫০০ টাকা। অথচ বেশিরভাগ স্কুলেই আদায় করা হয় এরচে অনেক বেশি টাকা। কোনো কোনো স্কুলে রেজিস্ট্রেশন/ফরম ফিলআপ ফি বাবদ ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা আদায় করার নজিরও রয়েছে। এ নিয়ে অভিযোগ করারও উপায় নেই।
মাধ্যমিকের পর শিক্ষার্থীরা উচ্চমাধ্যমিক স্তরে প্রবেশ করে কোনো কলেজে ভর্তি হয়। উচ্চমাধ্যমিক স্তরে এতদিন তেমন কোনো বাণিজ্য না থাকলেও ইদানীং এক্ষেত্রেও শুরু হয়েছে বাণিজ্যিকীকরণ। এতদিন উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বাণিজ্যের ধারাটা কলেজের শিকদের কাছে অথবা তাদের কোচিং সেন্টারে পড়া এবং কোনো কোনো ক্ষেত্র কলেজ কর্তৃক কিছু বেশি বেতন, ফি আদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বর্তমানে কলেজ পর্যায়ের বাণিজ্যও ভয়াবহ আকার নিয়েছে। ইদানীং টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রে ব্যাপক হারে বিভিন্ন কলেজের বিজ্ঞাপন দেখে এই বাণিজ্য সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। শুধু টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রে নয়, রাস্তাঘাটে পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ইত্যাদি যত ধরনের বিজ্ঞাপনের মাধ্যম আছে সব মাধ্যমেই প্রতিদিন অসংখ্য বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছে নানা কলেজের। এত এত বিজ্ঞাপন করার জন্য যে বিশাল অংকের ব্যয় হচ্ছে তা যে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই মুনাফাসহ তুলে নেয়া হবে তা সহজেই অনুমেয়। আর এ অনুমান সত্যি হয়, যখন দেখা যায় এত বিখ্যাত (!) কোনো কলেজের উচ্চমাধ্যমিক তথা কলেজের দুই বছরের ব্যয় প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা মাত্র (!)। প্রকৃতপে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীরা কাস করার সুযোগ পায় দেড় বছর বা তারও কম। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে ব্যয় প্রায় ৩০০০ টাকারও বেশি। এত টাকা বেতন বা খরচ ধার্য করার পেছনে এসব কলেজ কর্তৃপ হয়তো বলবেন মানসম্মত শিক্ষার কথা। অথচ দেশের স্বনামধন্য কলেজগুলোর মাসিক বেতন ও ফি ৪০০-৮০০ টাকার মধ্যে। উদাহরণ দেওয়া যায় ২০০৯ সালে ঢাকা বোর্ডে প্রথম সারিতে থাকা দুটি কলেজের মাসিক বেতনের : নটরডেম কলেজ ৬০০ টাকা আর ঢাকা সিটি কলেজ ৮০০ টাকা।
দুটি কলেজই বেসরকারি। তাহলে কী করে এত কম খরচে মানসম্মত শিক্ষা দিচ্ছে? আর সরকারি কলেজগুলোর বেতন উল্লেখ করার মতোই নয়। যেমন : ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, কবি নজরুল কলেজ ইত্যাদি কলেজগুলোর বেতন ২০-২৫ টাকার বেশি নয়।
আমাদের দেশে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব রয়েছে। তাই ভালো ভালো কিছু স্কুল, কলেজ স্থাপিত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সে সুযোগে শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করতে দেওয়া ঠিক হবে না বলে অভিমত অনেকের। এ সম্পর্কে সম্প্রতি নটরডেম কলেজের অধ্য এবং দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা সি.এস.সি.-র একটি বক্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বললেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন বিজ্ঞাপন দিয়ে শিক্ষার্থী খুজবে? শিক্ষার্থীরাই না শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করবে। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি এভাবে শিক্ষার্থী খোঁজে তবে বুঝতে হবে সেটি এখনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পারেনি। ’
দেশবাসী আশা করেন, ভালো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ব্যাপারে সরকার নজর দেবে। পাশাপাশি বাণিজ্যিক চিন্তা থেকে নয়, সমাজ ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে বিত্তবান ও শিল্পপতিরা এগিয়ে আসবেন নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও বিদ্যমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক সাহায্যে। আর যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করছে তারাও যেন দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে সেবা ও শিক্ষার মহান ব্রত নিয়ে কম খরচে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সুযোগ করে দেয়।